‘সহযোগীদের বাড়িতেই আস্তানা গাড়ছে জঙ্গিরা’

চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে ভুয়া পরিচয়ে বাসা ভাড়া করে নব্য জেএমবির জঙ্গিদের আস্তানা গড়ার কয়েকটি ঘটনা এর আগে ধরা পড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে তারা নিজেদের সংগঠনের সদস্যদের বাড়িকেই আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে বলে ধারণা পেয়েছে পুলিশ।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2017, 04:20 PM
Updated : 16 May 2017, 03:49 AM

ঝিনাইদহে নতুন দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলার পর রোববার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

“জঙ্গিদের এখন একটা নতুন ধরনের ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। তারা এখন নিজেদের সংগঠনের সদস্যদের বাড়িকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে। সেখানে নিরাপদে আশ্রয় নিচ্ছে; বিস্ফোরক ও অস্ত্র মজুদ রাখছে। পরবর্তী পরিকল্পনাও সেখানে বসে করছে।”

গত মার্চের শুরু থেকে এক মাসে চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ডের আমিরাবাদ ও প্রেমতলা, সিলেটের শিববাড়ি, মৌলভীবাজারের নাসিরপুর ও বরহাট এবং কুমিল্লার কোটবাড়ীতে সাতটি বাড়িতে অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এসব অভিযানে নারী-শিশুসহ ২৬ জন নিহত হন, প্রতিটি বাড়ি থেকেই উদ্ধার করা হয় আইইডিসহ (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক ও অস্ত্র।  

পুলিশ সে সময় জানিয়েছিল, কখনও পরিচয় গোপন করে, কখনও ভুয়া এনআইডি দেখিয়ে ওই সাত বাড়ি ভাড়া করেছিল জঙ্গিরা।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামে আব্দুল্লাহর বাড়িতে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক

এরপর গত ২০ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামে আব্দুল্লাহ নামে ধর্মান্তরিত এক ব্যক্তির বাড়ি ঘিরে অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। দুই দিনের অভিযান শেষে ওই জঙ্গি আস্তানা থেকে ২০টি কেমিকেল কন্টেইনার, ছয়টি বোমা, তিনটি সুইসাইড ভেস্ট, নয়টি সুইসাইড বেল্টসহ
 ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হলেও সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। 

ওই অভিযানের এক সপ্তাহের মাথায় ২৬ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আরেক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। ওই অভিযান শেষে চারজনের লাশ পাওয়া যায়, ভেতরে পাওয়া যায় অস্ত্র ও সুইসাইড ভেস্ট।

সর্বশেষ রোববার ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় এক বাড়িতে পুলিশের অভিযানে নব্য জেএমবির দুই জঙ্গি নিহত হন। আর সদর উপজেলার লেবুতলায় আরেক বাড়িতে পাওয়া যায় আটটি বোমা ও একটি ৯ এমএম পিস্তল।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসার ভাড়াটে রফিকুল ইসলাম আবু ও ঝিনাইদহের মহেশপুরের বাড়ির মালিক জহুরুল ইসলামও জেএমবির সঙ্গে যুক্ত বলে পুলিশের ভাষ্য। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পোড়াহাটির ওই বাড়ির মালিক ছিলেন আবদুল্লাহ নামে নব্য জেএমবির এক সদস্য। সেখানে ওইদিন যারা অবস্থান করছিলেন তারা আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।

সেই ঘটনার সূত্র ধরেই কাউন্টার টেররিজমের সদস্যরা ৫ মে ঝিনাইদহ থেকে শামিম নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেন। স্থানীয় বাসিন্দা শামিম আগে পুরনো জেএমবিতে থাকলেও পরে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন বলে মনিরুলের ভাষ্য।

তিনি বলেন, পুলিশের জানা মতে ঝিনাইদহে তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, যার পেছনে জঙ্গিরা ছিল। এছাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় জড়িত কেউ কেউ আগে ঝিনাইদহের এক বাড়িতে থেকে গেছেন কিছুদিন।

“তাদের আশ্রয় দেওয়া, দেখভাল করার ক্ষেত্রে শামিমের সম্পৃক্ততা পেয়েছি আমরা।”

মনিরুল জানান, নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী ও নিবরাস ইসলামের সহযোগী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই ঝিনাইদহে তৎপরতা চালিয়ে আসছিলেন শামিম। আর আবদুল্লাহ ছিলেন ঝিনাইদহে ‘নব্য জেএমবির’ বড় নেতা।

“তার পরে আরও দুই একজন আছে, যাদের এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু অনেক বড় বড় নেতা, সংগঠক গ্রেপ্তার হয়েছে বা মারা গেছে, তাই নিচের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে চলে এসেছে।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে এই বাড়িতে অভিযানে নিহত হয় সন্দেহভাজন চার জঙ্গি

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শামিমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে মনিরুল জানান, জহুরুলের বাড়িতে যে দুজন নিহত হয়েছেন তারা এক সময় আবদুল্লাহর বাড়িতে ছিলেন।

গতমাসে আবদুল্লার বাড়িতে অভিযানের আগে আগে তারা সরে যান এবং জহুরুলর বাড়িতে অবস্থান নেন। আর আবদুল্লাহ নিজে অবস্থান নেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রফিকুল ইসলাম আবুর বাসায়।

পরে ২৯ এপ্রিলের অভিযানে আবু ও আবদুল্লাহ দুজনেই ওই বাড়িতে নিহত হন। সেখানে নিহত অন্য দুই পুরুষের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল বলেন, “নব্য জেএমবির সদস্যদের বোমা তৈরির মূল ল্যাবরেটরি ছিল পোড়ামাটিতে আবদুল্লাহর বাড়ি। আমরা ইদানিং লক্ষ্য করছি, তারা যেখানে আশ্রয় নেয়, আত্মরক্ষার জন্য হলেও সেখানে বিস্ফোরক ও অস্ত্র রাখে। যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো অভিযানে গেলে তারা পাল্টা আক্রমণ করতে পারে।”

সহজে বিস্ফোরক সংগ্রহ ও সহজে পালিয়ে যাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করতে জঙ্গিরা সীমান্তবর্তী এলাকায় আস্তানা গড়ছে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মনিরুল বলেন, “সেটা তাদের একটা কৌশল হতে পারে। অন্যদিকে বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। বাসা ভাড়া নিতে গেলে বাড়ির মালিকরা পরিচয় জানতে চায়। এজন্য তাদের যারা অনুসারী রয়েছে এবং তাদের মধ্যে যাদের বাড়ি রয়েছে, সেখানে নিরাপদ ভেবে তারা সেখানে আস্তানা গাড়ছে।”

পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শামিমকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে কাউন্টার টেররিজমের সদস্যরা জানতে পারেন, ঝিনাইদহে তার বাড়ির মাটির নিচে বিস্ফোরক রয়েছে এবং আরেকটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান তার জানা রয়েছে।

ওই তথ্য পেয়ে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল করিমের নেতৃত্বে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি দল ঝিনাইদহে যায় এবং রোববারের অভিযান চালায়।

মনিরুল বলেন, মহেশপুরের যে বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা গেড়ে উঠেছিল, তার মালিক জহুরুল নিজেও জঙ্গিবাদে জড়িত। জহিরুল ও তার ছেলে জসিমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।     

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মহেশপুরের ওই বাড়িতে অভিযানের সময় আত্মঘাতী ভেস্টধারী এক জঙ্গি পুলিশের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করলে তাকে গুলি করা হয়। তাতে তার মৃত্যু হয়। আর আস্তানার ভেতরে অন্যজন আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হন।

নিহতদের মধ্যে একজনের নাম তুহিন বলে জানা গেলেও সেটি তার সাংগঠনিক- না আসল নাম, তা যাচাই করা হচ্ছে বলে জানান মনিরুল।

ওই অভিযানের নেতৃত্বে থাকা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল করিম ও একজন এএসআই আহত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।