সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলালেও পাল্টায়নি তাদের জীবন, পৌনে দুশো বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ঘুরছে একই বৃত্তে- চা শ্রমিক।
Published : 01 May 2017, 01:48 AM
বর্তমানে চা বৃহৎ পুঁজি ও শ্রমঘন এবং দীর্ঘমেয়াদি কৃষিভিত্তিক আন্তর্জাতিক শিল্প পণ্য হলেও বঞ্চনার জীবন কাটান তারা।
একাত্তরে এই ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের স্বাধীনতা এলেও এখনও ব্রিটিশ উপনিবেশের অনুশাসনে বাধা তাদের জীবন। সর্বোচ্চ দৈনিক মজুরি একশ টাকার কম, যা বাংলাদেশে আর কোনো পেশায় নেই বলেই সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য।
বাংলাদেশে চা’র আবাদ শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। ব্রিটিশ সাংবাদিক ড্যান জোনসের তথ্য অনুযায়ী, উনিশ শতকের মাঝামাঝি চুক্তিবদ্ধ শ্রমের (বন্ডেড লেবার) মাধ্যমে চা বাগানের কার্যক্রম শুরু হয়।
মূলত ‘আফিম যুদ্ধ’ ও চা’র আবিষ্কারক দেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে উপমহাদেশে প্ল্যান্টেশন ইকনোমি’র (চা, কফি, তুলা, আখ, রাবার- যার কোনোটিই মৌসুমী ফলনের উপর নির্ভরশীল নয় এবং শ্রমঘন শিল্প) বিস্তার ঘটায় ইংরেজরা। চা শ্রমিকদের এভাবে কাজে নিয়োজিত করাকে দাস প্রথা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
“লম্বা যাত্রাপথ এবং আসার পর প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে প্রায় এক তৃতীয়াংশ শ্রমিক মারা যায়।”
চা শ্রমিকের ইতিহাস লেখা পরিমল বলেন, ‘গাছ নাড়ালে সোনা পাবে’- এমন কথা বলে এই শ্রমিকদের কাজে আসতে প্রলুদ্ধ করা হয়। যদিও বলা হয়েছিল বছর শেষে তারা বাড়ি ফিরতে পারবে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে চুক্তির বিষয়াদি সম্পর্কে বিস্তারিত না জানায় পালিয়ে আসা ছাড়া কখনোই শ্রমিকরা আর তাদের ভিটেমটিতে ফিরতে পারেনি।
চা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত মোট ১৬২টি বাগান রয়েছে। তার মধ্যে ১৪৪টির মালিকদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশীয় চা সংসদ।
শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রতি দুই বছর পর পর মালিকদের সঙ্গে বসে শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য বিষয়াদির মীমাংসা করে তারা। সবশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর।
এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করার দাবি তোলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আইনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই এতদিনেও। এবার চা শ্রমিকের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার জন্যও সরকারের কাছে দাবি জানাই আমরা।”
| সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ অঞ্চলের চা বাগানের গড় উৎপাদন (কেজি) | চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি অঞ্চলের চা বাগানের গড় উৎপাদন (কেজি) | গ্রেড ০২ স্থায়ী শ্রমিকের (দৈনিক) বেতন (টাকা) | গ্রেড ০১ স্থায়ী শ্রমিকের (মাসিক) বেতন (টাকা) সর্দার, মিস্ত্রী, ধাই, পিয়ন, মেসেঞ্জার, লেদ অপারেটর | গ্রেড ০১ স্থায়ী শ্রমিকের (মাসিক) বেতন (টাকা) ইলেকট্রিসিয়ান, ড্রেসার |
ক্লাস এ চা বাগান | ১৮০,০০০ থেকে বেশি | ১১৩,০০০ থেকে বেশি | ৮৫ | ৪,৬৮০ | ৪,৮১০ |
ক্লাস বি চা বাগান | ১০৮,০০০ – ১৮০,০০০ | ৪৫,০০০ – ১১৩,০০০ | ৮৩ | ৪,৬৮০ | ৪,৮১০ |
ক্লাস সি চা বাগান | ২৭,০০০ – ১০৮,০০০ | ৪৫,০০০ থেকে কম | ৮২ | ৪,৬৮০ | ৪,৮১০ |
চা শিল্পে শ্রমিক কত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই এই শিল্পের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা বোর্ড ও বাংলাদেশীয় চা সংসদের কাছে। তবে শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাগানগুলোতে স্থায়ী, মৌসুমি ও চুক্তিবদ্ধ মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। এদের অর্ধেকেরও বেশি নারী শ্রমিক। তাদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৮০টি ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ।
উপরের তালিকায় দেখা যায়, কাঠামোগতভাবেই শ্রমের মূল্যের দিক থেকে এখানে পিছিয়ে আছেন নারীরা। যদিও বাগানের কাজ ও পারিবারিক দায়িত্ব মিলিয়ে এখানে বেশি শ্রম দিতে হয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এই নারীদের।
ডাক্তার, সহকারী ও ধাত্রীসহ শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল, ডিসপেনসারি বা গ্রুপ হাসপাতাল থাকার নিয়ম থাকলেও সেখানে সেবা বলতে তেমন কিছু পাওয়া যায় না।
কোম্পানি থেকে দেওয়া পুরনো কাঁচা ঘরবাড়ির ১০ শতাংশ হারে প্রতি বছর পাকা করার কথা থাকলেও কাঁচা ঘরবাড়ির মেরামতই ঠিকমত হয় না। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও চা বাগানের শ্রম কাঠামোর কারণেই তা উৎসাহিত হয়।
এ রকম নানা সমস্যার কারণে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন বাগানে মজুরি কিংবা অন্যান্য কারণে আন্দোলনে নামতে হয় শ্রমিকদের। বর্তমানে ধামাই, সোনারুপা ও আতিয়াবাগ নামের তিনটি বাগানের স্থায়ী শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছেন না প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে। অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি বন্ধ প্রায় ১৫ সপ্তাহ। রেশন নেই প্রায় ২৫ সপ্তাহ ধরে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এই তিন চা বাগানের মালিকপক্ষ ও বাংলাদেশীয় চা সংসদের বিভিন্ন সদস্যের সাথে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি।
চা শিল্প শ্রম কল্যাণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান জানান, কাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে মধ্যস্ততা করেন তারা।
“কোনো কোনো সময় অবশ্য আমরা সফল হতে পারি না। যেমন- ধামাই,সোনারুপা, আতিয়াবাগ বাগানের মালিকদের সাথে শ্রমিকদের আলোচনায় আমরা মধ্যস্ততা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মালিকপক্ষ সময় চেয়েছেন। ২৭ এপ্রিল আরেকবার আলোচনায় বসবার কথা থাকলেও মালিকপক্ষ এখন মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় চাচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “আমাদের হাতে মামলা করার সুযোগও আছে, কিন্তু অনেক সময়ই শ্রমিকরা মামলা-মোকদ্দমায় যেতে চান না। আবার সিলেট অঞ্চলেই শ্রম আদালতের কোনো আঞ্চলিক কার্যালয় না থাকায় পুরো প্রক্রিয়াটাই একটু জটিল।”
এই তিন বাগানের সমস্যা সম্পর্কে ‘কিছুই জানেন না’ বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব মো. নূরুল্লাহ নূরী।
নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বোর্ড একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও এর আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। সুতরাং শ্রমিকদের মজুরি বন্ধের মত অবস্থার সৃষ্টি হলে আমরা সাধারণত জেলা প্রশাসককে জানাই তার তহবিল থেকে সাহায্য করার জন্য বা লিজ বাতিল করার জন্য।
“অতীতে মালিকানা পরিবর্তনের মতো বিষয়েও মধ্যস্থতা করতেও গিয়েছি আমরা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে, এই সব বিষয়ে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করে আরও জটিল করে তোলে।”
চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি জানান, মূলত প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যগতভাবে চা বাগানের মালিক। শ্রমিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তারা ইংরেজদের তৈরি করে যাওয়া কাঠামোই অনুসরণ করে থাকেন।
বাংলাদেশের শ্রম আইনেও চা শ্রমিকদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। সংবিধানে যে কোনো ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে চিহ্নিত রয়েছে। আবার শ্রম আইন ২০০৬ এ বলা হয়েছে, শ্রমিকের চাকরির অবসান হলে যে কোনোভাবে ৬০ দিনের মধ্য তার মালিকের দেওয়া আবাসস্থল ছাড়তে হবে। কিন্তু এক সময়ের অভিবাসী চা শ্রমিকদের ভিটামাটি মূলত চা বাগানেই। তাই মালিকের বরাদ্দ করা বাসস্থান হারালে শ্রমিকদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। তার মাথাগোজার ঠাঁই ধরে রাখতে প্রতিটি পরিবারের কাউকে না কাউকে চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিকের চাকরি রাখতে হবে।
একইভাবে অর্জিত ছুটি, মুনাফায় শ্রমিকের অংশীদারিত্ব, শিশু শ্রম বা ন্যূনতম মজুরি বোর্ড; শ্রম আইনের এ বিষয়গুলোর কোনোটিই চা শ্রমিকদের বেলায় খাটছে না।
এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা রামভজন কৈরী বলেন, শ্রম আইনে বছরে ১০ দিন পূর্ণ মজুরিতে ছুটি পাওয়ার কথা থাকলেও, বলা হয়েছে এটি চা শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
“তাই আমাদের দাবি, উপরে উল্লেখিত প্রথম ধারার ‘চা শ্রমিকের জন্য প্রযোজ্য নয়’ লাইনটি কেটে তা বরং উল্লেখিত দ্বিতীয় ধারার শেষে জুড়ে দেওয়া হোক। এতে খুব দ্রুত আমাদের অন্তত দুটি অধিকার নিশ্চিত হবে।”
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এছাড়া চা শিল্পের উন্নয়নে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে সরকার। তবে শিল্পের অন্যান্য বিষয়ের মতো শ্রমিক উন্নয়নের বিষয়টি এখানে কাঠামোগতভাবে নির্দেশ না করা হলে, তা আসলে শ্রমিদের কতটুকু কাজে লাগবে সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
এই বিষয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বুণার্জি বলেন, “চা বাগানের শ্রমিকদের সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে উচ্চ শিক্ষা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা চালু করার আবেদন জানাচ্ছি। একই সাথে অন্য শিল্পের থেকে কিছুটা ভিন্ন হওয়ায় এই শিল্প বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য আলাদা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও গড়ে তোলা যেতে পারে।”
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চা বাগান ব্যবস্থাপনা সেলের মহা-ব্যবস্থাপক মো. শাহাজাহান বলেন, “বর্তমানে আমাদের দেশ কোয়ালিটি থেকে কোয়ান্টিটির দিকে মনযোগ দেয় বেশি। চা খুবই সেনসিটিভ একটি পণ্য। চা শিল্পের মান উন্নয়ন করতে হলে স্বল্পমেয়াদি,মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন।
“এক্ষেত্রে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই শিল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষেরও একসাথে কাজ করতে হবে। অন্য যে কোনো শিল্পের তুলনায় এই শিল্পের শ্রমিকেরা আরও বেশি প্রান্তিক। এই অবস্থার উন্নয়নে কাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে সব পক্ষের এসাথে কাজ করতে হবে।”