আইনের শাসনের জন্যই আমাকে বলতে হচ্ছে: প্রধান বিচারপতি

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেছেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়’ বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে বলেই তাকে কথা বলতে হচ্ছে।  

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2017, 03:15 PM
Updated : 2 May 2017, 12:34 PM

তিনি বলেছেন, “পাকিস্তানে ১৯৭৩ সালের পর থেকে নিম্ন আদালতে যে আইনের শাসন চলছে, তা আজকে আমরা পাইনি। বাংলাদেশে এখনও হয়নি। ভারত তো অনেক উপরে, শ্রীলংকা অনেক উপরে, নেপালতো আরও অনেক উপরে।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে রোববার ভূ‌মি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভা‌গের উদ্বোধ‌নী অনুষ্ঠা‌নে এ কথা বলেন প্রধান বিচারপতি।

কোনো দেশে প্রধান বিচারপতিরা ‘প্রকাশ্যে এত কথা বলেন না’- আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের এমন মন্তব্যের চার দিনের মাথায় বিচারপতি সিনহার এই বক্তব্য এল।  

দীর্ঘ বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি যখন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন, তখনই তার ওই বক্তব্য আসে। 

“পৃথিবীর উন্নত দেশে, এমনকি ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় বিচারপতিরা, প্রধান বিচারপতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেগুলারলি লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কথা পত্রিকায় বের হয় না, আপনাদের প্রধান বিচারপতির বক্তব্য পত্রিকায় বের হয়। তার একটাই কারণ। আমরা সেই পর্যায়ে যেতে পারিনি। আমাদের আইনের শাসন আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।”

বিচারপতি সিনহা বলেন, যে পাকিস্তানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, বৈষম্য দূর করার জন্য বঙ্গবন্ধু য়ৌবনে জেল খেটেছেন; যে দেশে সংবিধানকে এক সময় বলা হত ‘আইয়ুবের সংবিধান’, পাকিস্তানি সংবিধান নয়, সেখানেও নিম্ন আদালতে আইনের শাসন চলছে।

“পাকিস্তানের মত দেশে সুপ্রিম কোর্ট যা বলে, নিম্ন আদালতের প্রমোশনসহ সবকিছু সেভাবে চলে। ওখানে আইনের শাসন বলতে… বিচারকদের স্বাধীনতা- এটা সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া আর কেউ ইয়ে করবে না্। পৃথিবীতে সর্বত্র এটা বহাল আছে। শুধু বাংলাদেশে যেহেতু থাকছে না, এই কারণে প্রধান বিচারপতি বলতে বাধ্য হচ্ছে, এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।”

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আদালতের পাশাপাশি সরকার ও সাধারণ জনগণকেও যে এগিয়ে আসতে হবে, সে বিষয়টি বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলেন প্রধান বিচারপতি।

তিনি বলেন, আদালত রায় দেওয়ার পর তা বিরুদ্ধে গেলে কেউ কেউ এমন সব মন্তব্য করেন, যে বিচারকরাও কষ্ট পান।

“কোনো মতেই আমরা নিজেদেরকে সভ্য হিসেবে দাবি করতে পারব না, যতদিন পর্যন্ত আমরা সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারব। সেটা যদি আমার বিরুদ্ধেও যায়, তা আমি মাথা পেতে নেব।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন প্রণেতারা সংসদে বসে আইন প্রণয়ন করেন, সংবিধান রচনা করেন। আর সংবিধান আইনের ব্যাখ্যা দেওয়ার অধিকার দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে।

“এই সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য সময়ে সময়ে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনা দিয়ে থাকে। এটাকেই মানতে হবে।… তখনই একটি সভ্য দেশ হিসেবে এই পৃথিবীর বুকে আমরা দাবি করতে পারব।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যের প্রসঙ্গও টানেন প্রধান বিচারপতি।

“কিছু দিন আগে দুটি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ- রাষ্ট্রের এই তিন বিভাগের কারও ওপরে কারও প্রাধান্য না দিয়ে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে হবে। এটাই হল আমাদের মূল এস্টিম। আমি সব সময় তাই বলে আসছি।”

কীভাবে তা করা হবে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, “জুডিশিয়াল রিভিউয়ের ক্ষমতা সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া হয়েছে। একটি আইন যদি আরেকটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত দেবে সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধান সেই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে।”

আর সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণেই সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেছে বলে জানান বিচারপতি সিনহা।

তিনি বলেন, কেরালার একটি বিখ্যাত মামলার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে সংবিধানে একটি ক্লজ যুক্ত করে বলা হয়েছিল, একটি অংশ কোনো অবস্থাতেই পরিবর্তন করা যাবে না। এ নিয়ে একটি মামলায় ১৩ জন বিচারক ঐতিহাসিক রায় দেন, সংবিধানের মৌলভিত্তি কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না।

অর্থাৎ, সাংসদরা সংবিধান সংশোধন করে অপরিবর্তনীয় ধারা যোগ করতে পারেন, কিন্তু মৌলভিত্তিতে আঘাত হলে তা অবৈধ ঘোষণা করতে পারে সুপ্রিম কোর্ট।  

“আমরা কোনোদিনই কুণ্ঠিত হব না, ভবিষ্যতে যদি এমন কোনো আইন হয়, সেটা যদি সংবিধানের সঙ্গে কনফ্লিকট করে, এটা একমাত্র বিচার বিভাগের ক্ষমতা, সংবিধানকে যদি আমরা শ্রদ্ধা করি, তাহলে সংবিধানেকে সমুন্নত করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট কখনো পিছপা হবে না।”

বিশ্ব‌বিদ্যালয় ভূ‌মি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ক্রিস্টিন রিচার্ডসনের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ব‌বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সে‌লিম ভূইয়া, আইন অনুষ‌দের ডিন অধ্যাপক সরকার আলী আককাস বক্তব্য দেন।