‘হুমায়ুন আজাদকে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে’

লেখক শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদকে জীবদ্দশায় এমনকি মৃত্যুর পরও নানাভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার সহকর্মী শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 April 2017, 12:21 PM
Updated : 29 April 2017, 12:21 PM

শনিবার রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরে হুমায়ুন আজাদ স্মরণসভায় এসে তার কাব্য ও গদ্য সাহিত্য নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই অভিযোগ আনেন বক্তারা।

স্মরণসভায় বক্তব্য দেন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব আকতারী মমতাজ, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান বেগম আকতার কামাল, অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান এবং কবি মাসুদুজ্জামান।

সভায় বক্তারা তাকে ‘প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক সত্তার এক কবি’ হিসেবেও অভিহিত করেন।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে টিএসসির দিকে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে হুমায়ুন আজাদকে।

কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ওই বছর অগাস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান এই লেখক। পরে ১২ অগাস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী স্বাগত ভাষণে বলেন, “হুমায়ুন আজাদ ছিলেন শক্তিশালী গদ্যকার। তার গদ্য সাহিত্যে আমরা সেই ব্যাপকতা ও গভীরতার স্বাক্ষর পাই। প্রচলিত ধারার বাইরে এসে তিনি অসম সাহসিকতার সাথে শাসকদের নিন্দা করেছিলেন। মেরুদণ্ড শক্ত রাখার এমন মানসিকতা খুব কম দেখা যায়।”

মূল প্রবন্ধ পাঠ করতে এসে বেগম আকতার কামাল স্মরণ করলেন তার সহকর্মী অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের কথা। তার পাঠদান পদ্ধতি, ভাষা জ্ঞানের পাশাপাশি হুমাযুন আজাদের কাব্যপ্রতিভা নিয়ে আলোকপাত করেন তিনি।

তিনি বলেন, “হুমায়ুন আজাদ সবসময় নিজেকে কবি বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তার গদ্যসাহিত্যেও কিন্তু সেই কবিতার প্রভাব পড়েছিল। তার কবিতা প্রাঞ্জল ও অসাধারণ। তার কবিতায় আমি বুদ্ধদেব বসুর প্রভাব দেখতে পাই।”

হুমায়ুন আজাদকে রোমান্টিক সত্তার কবি হিসেবে উল্লেখ করে বাংলার এই অধ্যাপক বলেন, “ রাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে শাসককূলের মুখোশ কবিতায় তিনি বারবার উন্মোচন করেছেন। অন্য কবিরা যখন বলেছেন, আমাদের প্রজন্ম থাকবে দুধেভাতে; তখন তিনি বলেছেন মৃত্যুর মিছিলের কথা। সত্যকে লুকাতে পছন্দ করতেন না তিনি। তার লেখায় বারবার উঠে এসেছে রাষ্ট্রচিন্তার কথা।”

তিনি অভিযোগ করেন, হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধ সাহিত্য নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ হয়নি। কখনও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে তাকে।

বাংলা সর্বনামের উপর করা হুমায়ুন আজাদের গবেষণাকর্মকে ‘প্রণিধানযোগ্য’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

কবি মাসুদুজ্জামান বলেন, “একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা কেমন সমাজ চাই, জাতিগতভাবে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই, তা তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে বলে গেছেন।”

‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি দিয়েই হুমায়ুন আজাদকে মূল্যায়ন করে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারই ছাত্র অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান।

তিনি বলেন, “আমরা তার ‘ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল’ উপন্যাস থেকে শুরু করে শেষ লেখাগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাব, কী গভীর মনস্তাত্ত্বিক কোণ থেকে তিনি মানুষকে দেখেছেন।

“সামাজিক বাস্তবতাকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করেই তিনি বারবার রাজাকারদের পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। জাতীয় জীবনে রাজাকারদের সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাবের কথা তিনি বারবার বলে গেছেন। যে জন্য জীবনও দিতে হল তাকে।”

প্রধান অতিথি আকতারী মমতাজ বলেন, “সমাজের গভীরের অন্তঃস্রোতকে দেখতে পেয়েছিলেন কবি হুমায়ুন আজাদ। দেশপ্রেমিক, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন দূরদ্রষ্টা এই কবি সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে এতটুকু দ্বিধা করতেন না। তার লেখনীর মধ্য দিয়ে নবপ্রজন্ম আলোড়িত হয় এখনও।”

সভাপতির বক্তব্যে কবি মুহাম্মদ সামাদ হুমায়ূন আজাদকে ‘এক প্রথাবিরোধী কবি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। হুমায়ুন আজাদের জাতীয় কবিতা পরিষদের সদস্যপদ হারানোর নানা প্রেক্ষাপট, রাজাকারবিরোধী আন্দোলনের নানা ধারাপাত উল্লেখ করেন তিনি।

“তাকে নাস্তিক উপাধি দেওয়া হল। আমরা তার জন্য আন্দোলন করলাম। আমার গ্রামের বাড়িতে হুমকি দিল, আমি বাড়ি ফিরলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে।”

এসময় তিনি বলেন, “তার ‘বই’ কবিতাটি আমাদের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলে গেছেন, ‘সেই বই তুমি পড়বে, যে বই তুমি তোমাকে স্বপ্ন দেখায়’। সেই কবিতাটি বাদ দেওয়া হল। অথচ আজকাল যেসব বই পড়ছে শিশুরা, সেগুলো ভীষণ ভয়াবহ।”

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ছিলেন প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক মননশীল লেখক। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির বেশি। আজাদের ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।

তার ‘নারী’ (১৯৯২), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (২০০১) এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪) গ্রন্থ তিনটি বিতর্কের ঝড় তোলে এবং পরবর্তীতে সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে।

তাকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।