জুলহাজ-তনয় হত্যা: তদন্ত প্রতিবেদন ‘সহসা হচ্ছে না’

এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঢাকার কলাবাগানে সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2017, 01:37 PM
Updated : 25 April 2017, 04:47 PM

এ মামলার তদন্ত তদারকের দায়িত্বে থাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রাজিব আল মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, অভিযোগপত্র ‘খুব তাড়াতাড়ি দেওয়ার সম্ভাবনা কম’।

“কারা করেছে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করব গ্রেপ্তারের জন্য, এরপর চার্জশিট দেওয়া হবে।”

এদিকে এক বছরেও তদন্তের অগ্রগতি না দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন জুলহাজ মান্নানের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান।

মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তদন্তের ফলাফল একদম শূন্য, মহাশূন্য। সেখানে কারও আগ্রহ নেই, কোনো অগ্রগতি নেই। ঘটনার সময়ই ছিলো আলোচনা। এরপর কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি।”

গতবছর ২৫ এপ্রিল বিকালে পার্সেল দেওয়ার কথা বলে কলাবাগানের লেক সার্কাস এলাকায় জুলহাজ মান্নানের বাসায় ঢুকে পাঁচ থেকে সাতজন যুবক তাকে এবং তার বন্ধু তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক দীপু মনির খালাত ভাই জুলহাজ (৩৫) ছিলেন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইডের কর্মী। সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন তিনি।

তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় (২৬) ছিলেন লোকনাট্য দলের কর্মী। পিটিএ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ‘শিশু নাট্য প্রশিক্ষক’ হিসেবেও তিনি কাজ করতেন।

জুলহাজের ভাই মিনহাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই ঘটনার দিন পুলিশ যোগাযোগ করেছিল। এরপর থেকে তারা এক বছরে আর মামলা নিয়ে কোনো যোগাযোগ করেনি। আমরা এই হত্যার তদন্ত নিয়ে অত্যন্ত হতাশ।”

জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডের পর বাড়ির সামনে ভিড়

মিনহাজ জানান, তার ছোট ভাইকে যখন হত্যা করা হয়, তাদের বৃদ্ধা মাও তখন বাড়িতে ছিলেন। আসলে কী ঘটেছিল, তার কাছে তা এখনও আড়াল করে রেখেছেন তারা।

“মায়ের বয়স ৭৮/৭৯ হয়েছে। অল্প সময়ে অনেক কিছু ভুলে যান। জুলহাজের মৃত্যুর কথা তাকে এখনো সেভাবে জানানো হয়নি। ওর কথা জানতে চাইলে কখনো বলা হয় অফিসে গেছে, আবার কখনো বলা হয় দেশের বাইরে।”

জুলহাজ-তনয়কে হত্যার পর খুনিরা পালানোর সময় ওই বাড়ির দারোয়ান পারভেজ মোল্লাও তাদের হামলার শিকার হন। একজনের কাছ থেকে একটি ব্যাগ ছিনিয়ে রাখেন কলাবাগান এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এএসআই মমতাজ, যেখানে একটি পিস্তল, একটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মোবাইল ফোন পাওয়ার কথা সে সময় জানানো হয়।

ঘটনার রাতেই মিনহাজ মান্নান অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আর এএসআই মমতাজের ওপর হামলা এবং অস্ত্র পাওয়ার ঘটনায় কলাবাগান থানার এসআই শমীম আহমেদ করেন আরেকটি মামলা।

এ দুই মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুইজনকে, যাদের একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য আদালতের কাছ থেকে ১২ বার সময় নিয়েও তা দিতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা।

আদালত আগামী ৮ মের মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে বললেও তা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন না অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রাজিব আল মাসুদ।

পুলিশের ধারণা, খুনিরা ‘দেশেই আছে’

বাংলাদেশে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে একের পর ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, ভিন্ন মতাবলম্বী ধর্মগুরু এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যার মধ্যে সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ ও তনয়ের হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় বিভিন্ন দেশ। 

আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ (একিউআইএস) শাখা ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে খবর এলেও পুলিশের পক্ষ থেকে দেশীয় উগ্রপন্থিদের দায়ী করা হয়।

পুলিশ বলছে, জুলহাজ-তনয়ের খুনিদের অস্ত্র জুগিয়েছিলেন শরিফুল ইসলাম ওরফে শিহাব

ঘটনার ১৯দিন পর পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটের সদস্যরা কুষ্টিয়া থেকে শরিফুল ইসলাম ওরফে শিহাবকে এ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক বাহাউদ্দিন ফারুকী সে সময় বলেছিলেন, শিহাব আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। জুলহাজকে হত্যার জন্য শিহাবই খুনিদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন বলে তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছেন।

রাশেদ উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে রায়হান নামে আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের আরেক সদস্যকে গত বছর গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন বলে তদন্ত তদারক কর্মকর্তা রাজিব আল মাসুদ জানান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, রায়হান নিজে সরাসরি হত্যায় অংশ না নিলেও হত্যা পরিকল্পনার কথা তার জানা ছিল বলে জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন।

“জুলহাজ মান্নান বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ওই হত্যায় অন্তত ১০ জন জড়িত ছিল। যাদের পাঁচজন সরাসরি হত্যায় অংশ নেয়।”

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, রায়হান আদালতে ওই পাঁচজনের সাংগঠনিক নামও বলেছেন। পুলিশ নামগুলো খতিয়ে দেখছে।  

রাজিব আল মাসুদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “যারা হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল তাদের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার খবর পুলিশের কাছে নেই। পুলিশের ধারণা তারা দেশেই আছে। তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।”

মামলার আরেক তদন্ত তদারক কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, “যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে।”