অনিয়মে আটকে কুষ্টিয়া মেডিকেলের নির্মাণ

কুষ্টিয়া ও এর আশপাশের জেলার মানুষের অন্তত ২০ বছর পরের চাহিদা মাথায় রেখে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে কাজ শুরু করে দেওয়ার পর দর বাড়িয়ে কার্যাদেশ দেওয়াসহ নানা অনিয়মে আটকে গেছে সেই কাজ।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2017, 05:08 AM
Updated : 25 April 2017, 05:08 AM

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ‘বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’ (আইএমইডি) পরিদর্শনের পর তাদের এক প্রতিবেদনে প্রকল্পটির সবকটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নকশা পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেঁধে দেওয়া ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন করে অনুমোদন না নিয়েই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, যা ক্রয় আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’।

২০১২ সালের ৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের সভায় ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ের কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। তিন বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচ বছর পরও তা শেষ হয়নি।

এ অবস্থায় উদ্বোধনের পর চার বছর ধরে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের পাশে ‘মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস)’ ক্যাম্পাসে জোড়াতালি দিয়ে চলছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের পাঠদান।

অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়ার ১৮ লাখ মানুষসহ আশপাশের আরও কয়েকটি জেলার আরও কয়েক লাখ মানুষের কাঙ্ক্ষিত এ মেডিকেল কলেজের নির্মাণকাজ কবে শেষ হবে, এখন তা বলতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

আইএমইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নের’ অংশ হিসেবে আগামী ২০ থেকে ৩০ বছর পরও ওই এলাকার জনগণকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার উপযোগী নকশা করে এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।

“কিন্তু এখন ভবনগুলোর অবয়ব ছোট করে ফেলায় ১০ বছর পরই এর উপযুক্ততা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।”

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এ প্রকল্প পরিদর্শন শেষে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় আইএমইডি। প্রকল্প পরিচালকের ‘দায়িত্বে অবহেলার’ কারণে যথাসময়ে প্রকল্প ‘প্রক্রিয়াকরণ বা সংশোধন’ করা হয়নি বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়।

এ ‘চরম অনিয়মের’ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রকল্প পরিচালক এবং গণপূর্ত বিভাগের কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলীকে দায়ী করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে চিহ্নিত অনিয়ম

একাডেমিক ভবন

# একনেক অনুমোদিত নকশায় মূল একাডেমিক ভবনের ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) ছিল ৩৫ হাজার বর্গফুট।কিন্তু বাস্তবায়নের সময় তা প্রায় ৮ হাজার বর্গফুট কমিয়ে ভিত্তি করা হয়েছে ২৭ হাজার ২২৬ বর্গফুটের।

# ছয় তলা ভিত্তির উপর ছয় তলা ভবন তৈরির নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য একনেক ব্যয় ধরে ৩০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।এর মধ্যে শুধু ভবন নির্মাণের অনুমোদিত ব্যয় ২৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

# কিন্তু ছয় তলা ভিত্তির উপর শুধু চার তলা ভবন তৈরির জন্য ২০১৩ সালে ২৯ কোটি ৮১ লাখ টাকার একটি চুক্তি হয়, যা নির্ধারিত দরের চেয়ে ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

# এছাড়া এই প্যাকেজে থাকা সাব-স্টেশন ভবন, লাইট-সাউন্ড-ইকুইস্টিক সিস্টেম, লিফট, সাব-স্টেশন ভবন থেকে ভবনটির বিভিন্ন তলায় এলটি ক্যাবল, লাইটেনিং, পিবিএক্স সিস্টেম, পাম্প মটর, ৫০ হাজার গ্যালনের ওয়াটার রিজার্ভার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ৯২৯ বর্গমিটারের চিলেকোঠা এবং ৫০ হাজার গ্যালনের আরসিসি ওয়াটার ট্যাংকসহ বেশ কিছু কাজ বাদ রেখেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

হাসপাতাল ভবন

# হাসপাতাল ভবনের ১ লাখ ৫৫ হাজার বর্গফুট ভিত্তির পরিবর্তে করা হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার বর্গফুট, যা অনুমোদিত নকশার চেয়ে ১৭ হাজার বর্গফুট কম।

# নকশায় হাসপাতাল ভবনটি ১০ তলা ভিত্তির উপর সাত তলা নির্মাণের কথা থাকলেও তা করা হয়েছে ১০ তলা ভিত্তির ওপর তিন তলা।

# এ ভবনের জন্য ১১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৯২ কোটি ২৪ লাখ টাকার চুক্তি হয়।‘আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভার’ নির্মাণ এ প্যাকেজে থাকলেও এরজন্য আলাদা চুক্তি করা হয়েছে।

ছাত্রাবাস ভবন

# ছাত্রাবাস নির্মাণের ক্ষেত্রে ছয় তলা ভিত্তির ওপর ছয় তলা ভবন নির্মাণে পুরো প্যাকেজের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল আট কোটি সাত লাখ টাকা। এরমধ্যে শুধু ভবন নির্মাণ ব্যয় ছিল সাত কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু ছয় তলা ভিত্তির উপর চার তলা ভবন নির্মাণেই চুক্তি হয় ৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার। এছাড়া আরও এক কোটি ১১ লাখ টাকার অননুমোদিত ব্যয় দেখানো হয়।

# এ ভবনটির ভিত্তি ১০ হাজার ৫৪৫ বর্গফুট করার কথা। কিন্তু বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে কোনো তথ্য জানায়নি।

# ছয় তলা ভিত্তির উপর ছয় তলার ছাত্রী হল নির্মাণে বরাদ্দ ছিল আট কোটি সাত লাখ টাকা। অনুমোদিত ব্যয় ছিল সাত কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু চার তলার ভবন নির্মাণেই চুক্তি হয় সাত কোটি ৮৬ লাখ টাকার।

# ভবনটি ১০ হাজার ৫৪৫ বর্গফুট ভিত্তির উপর করার কথা থাকলেও বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠান কোন তথ্য জানায়নি।

আবাসিক ভবন

# চিকিৎসকদের আবাসিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি দরে বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। ভবনটি নির্মাণে বরাদ্দ ছিল দুই কোটি ২০ লাখ টাকা এবং অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয় দুই কোটি চার লাখ টাকা। কিন্তু চুক্তি করা হয় দুই কোটি ১৭ লাখ টাকায়।

# ভবনটির মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা এক ফুট করে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ভবনের ক্ষেত্রেও মোট ভিত্তির আয়তন সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, একাডেমিক ভবন নির্মাণে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হিসাবে ভবনটির নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। দুই দফায় দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর পর তা গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এসময়েও কাজ শেষ না হওয়ার পর মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি।

আইএমইডির এই প্রতিবেদন জমার পর পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ নতুন করে আর না বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেক কাজ এখনও বাকি থাকায় প্রকল্প এলাকাটি এখন অনেকটাই পরিত্যক্ত রূপ নিয়েছে।

এ অবস্থায় মেয়াদ দ্রুত বাড়িয়ে তা শেষ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন প্রকল্পটির বর্তমান পরিচালক ডা. আশরাফুল হক।

এক বছর আগে এ দায়িত্ব পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আগের প্রকল্প পরিচালক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, তারা প্রকল্পের নকশা অনুযায়ীই স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।”

চলতি মাসের মাঝামাঝি তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভায় এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব উঠেছিল। আইএমইডির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে তারা কিছু দলিলপত্র হালনাগাদ করতে বলেছে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের যুগ্মপ্রধান সৈয়দ মামুনুল আলম বলেন, “প্রকল্পটি অবশ্যই শেষ করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আইএমইডিকে যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়ে এ সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তা বের করতে হবে।”

আইএমইডি সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ খান সম্প্রতি বদলি হওয়ার পর এখনও নতুন কেউ দায়িত্ব নেননি। ফলে এ বিষয়ে আইএমএইডি হালনাগাদ সিদ্ধান্তও জানা যায়নি।

প্রকল্প পরিদর্শন করা আইএমইডির দলটির এক কর্মকর্তা জানান, আগের প্রকল্প পরিচালক ডা. ইফতেখার মাহমুদের অধীনেই প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ হয়েছে। ইফতেখার মাহমুদ দুই মাস আগে অবসরে গিয়ে কুষ্টিয়া ছেড়েছেন।

মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রকল্পটির বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে আরও কয়েকবার ফোন করা হলে তিনি আর তা ধরেননি। 

বর্তমানে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত বিভাগের কুষ্টিয়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান অনিয়মের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি প্রথমে বলেন, “পূর্ত কাজের জন্য অধিদপ্তরে নকশা তৈরি করা হয়। আমি সেই নকশা অনুযায়ী কাজ করেছি।”

কিছুক্ষণ পর তিনিই আবার বলেন, “আমরা কেন নকশা অনুযায়ী কাজ করতে পারিনি, সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এর বেশি কিছু আপনাকে জানাতে আমি বাধ্য নই।”

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় (স্বাস্থ্য) এবং দায়িত্ব পালনকারী কার্যালয় (গণপূর্ত বিভাগ) থেকে পাওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনগুলোতে ‘একেক রকম’ তথ্য দেওয়া হয়েছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সেখানে বলা হয়, একনেকে পাস হওয়া প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী একাডেমিক ও হাসপাতাল ভবন এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়া অন্য ভবনগুলোর অর্ধেক নির্মাণ করার কথা। ভবিষ্যতে প্রয়োজন অনুযায়ী বাকি অংশ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু সবগুলো ভবনের ভিত্তি অনুমোদিত প্রস্তাব মত থাকার কথা বলা হলেও তা লঙ্ঘন করা হয়েছে।

“প্রকল্পটির অন্যতম শর্ত ছিল, অনুমোদিত প্রস্তাবের বাইরে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। অথচ অনুমোদনের পর ওই সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে অধিকাংশ নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।”

প্রকল্পটির অনুমোদিত ক্রয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব ক্রয় প্রক্রিয়ায় ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব’ দেখা গেছে বলেও আইএমইডির অনুসন্ধানে দেখা গেছে।

একক কাজের কিছু অংশ বাদ রেখে কার্যাদেশ প্রদান এবং অনুমোদিত পরিধি হ্রাস ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হলেও কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।