কিশোরগঞ্জের দুই যুদ্ধাপরাধীর প্রাণদণ্ড

একাত্তরে কিশোরগঞ্জ এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে তখনকার রাজাকার বাহিনীর সদস্য মোসলেম প্রধান ও পলাতক সৈয়দ মো. হুসাইনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

মেহেদী হাসান পিয়াসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2017, 06:16 AM
Updated : 19 April 2017, 12:05 PM

বিচারপতি আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বুধবার এই রায় ঘোষণা করে।

রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আসামিদের সাজা কার্যকর করতে হবে।

সেই সঙ্গে পলাতক মো. হুসাইনকে গ্রেপ্তার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিতে বলা হয়েছে।

ছয় অভিযোগের মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে নিকলীর গুরুই গ্রামে নির্বিচারে ২৬ জনকে হত্যার দায়ে সর্বসম্মতভাবে দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। 

চতুর্থ অভিযোগে নিকলীর নানশ্রী গ্রামে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও হিন্দুদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর ৩৪ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আসামি হুসাইনের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারীদের টার্গেট করে ব্যাপক হারে ধর্ষণের ঘটনাকে আদালত বিবেচনা করেছে গণহত্যার সমতুল্য অপরাধ হিসেবে। 

পঞ্চম অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মালেককে ধরে নিয়ে হত্যার ঘটনায় আসামি হুসাইন ও মোসলেমকে সর্বসম্মতভাবে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

এছাড়া আরও তিন অভিযোগে আসামি হুসাইনের মোট ২২ বছরের কারাদণ্ডের রায় এসেছে ট্রাইব্যুনালে।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, দুই আসামি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাদের মধ্যে হুসাইন নিকলি থানা এলাকায় ‘রাজাকার দারোগা’ হিসেবে এবং মোসলেম প্রধান নিকলি ইউনিয়নে রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

তারা তখনকার কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে।

হুসাইনের বড় ভাই সৈয়দ মো. হাসান ওরফে হাছেন আলীকেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃতুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ভাইয়ের মত হাছেন আলীও পলাতক।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ে আমরা অত্যন্ত খুশি। সফলভাবে কাজ করতে পেরেছি। দুটো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, একটি আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অপর তিনটি অভিযোগে ২২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে।”

একটি দিক দিয়ে এ মামলায় ‘অসাধারণ সাফল্য’ এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই রায়ে প্রথমবারের মত যুদ্ধকালীন ধর্ষণকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একাত্তরের গণধর্ষণকে আদালত ‘জেনোসাইডাল রেপ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ওই চার্জে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, “ট্রাইব্যুনাল ও আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। মক্কেলের সঙ্গে পরামর্শ করে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যায়। তবে পলাতক পলাতক সৈয়দ মো. হুসাইনকে সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ২৮টি মামলার ৪৮ আসামির মধ্যে মোট ৩০ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হল।

 

কোন অভিযেগে কী সাজা

 

অভিযোগ

আসামি

সাজা

নিকলীর দামপাড়া গ্রামে হিন্দুদের ধর্মান্তরে বাধ্য করা

হুসাইন

৭ বছর কারাদণ্ড

নিকলী বাজার ও থানা কম্পাউন্ড এলকায় চারজনকে অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতন

হুসাইন

৫ বছর কারাদণ্ড

নিকলীর গুরুই গ্রামের পূর্বপাড়ায় ২৬ জনকে হত্যা এবং ২৫০টি বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ

হুসাইন ও মোসলেম

মৃত্যুদণ্ড

নিকলীর নানশ্রী গ্রামে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও হিন্দুদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর গণহত্যা

হুসাইন

মৃত্যুদণ্ড

নিকলী সদরের পূর্বগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মালেককে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে হত্যা

হুসাইন ও মোসলেম

আমৃত্যু কারাদণ্ড

মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান ও মো. সেলিমকে হত্যার পর তাদের মৃতদেহ রিকশায় করে কিশোরগঞ্জ পৌরসদর, প্যারাভাঙা ও শোলাকিয়ায় ঘুরিয়ে দেখানো

হুসাইন

১০ বছর কারাদণ্ড

বুধবার বেলা সাড়ে ১০টার আদালত বসার পর ১১টার কিছুক্ষণ আগে কিশোরগঞ্জের দুই আসামির রায়ের কার্যক্রম শুরু হয়।

তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, তারা যে রায় দিতে যাচ্ছেন, তা এসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।

পরে বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রায়ের সার সংক্ষেপ পড়া শুরু করেন। অপর বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদীও পড়বেন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে বিচারপতি আনোয়ারুল হক সাজা ঘোষণা করেন।

দুই আসামির মধ্যে মোসলেম প্রধানকে সকালে রায়ের জন্য কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। আর পলাতক হুসাইন মালয়েশিয়ায় রয়েছেন বলে প্রসিকিউশনের তথ্য।

সৈয়দ মো. হুসাইন ওরফে হোসেন

সৈয়দ মোসলেহ উদ্দিন ও সৈয়দা ফাতেমা বানুর ছেলে মো. হুসাইনের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।তার স্থায়ী ঠিকানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা হলেও তার সর্বশেষ বর্তমান ঠিকানা ছিল ঢাকার খিলক্ষেতের পিংক সিটির ৬ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাড়ি। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরে থাকতেন বলে প্রসিকিউশনের তথ্য।

হুসাইন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি ও ১৯৭৫ সালে বিএ পাশ করেন।  মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মতাদর্শ গ্রহণ করেন।

ওই সময় নিকলি থানা এলাকায় ‘রাজাকার দারোগা’ হিসেবে পরিচিত হুসাইন কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগ। তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক সৈয়দ মো. হাসান ওরফে হাছেন আলীর ছোটভাই।

মো. মোসলেম প্রধান

১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের নিকলি থানার কামারহাটি গ্রামে মোসলেমের জন্ম। তার বাবা লাভু শেখ ও মা রেজিয়া আখতার। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই; তবে অক্ষরজ্ঞান আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিকলি ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগ।

মোসলেম পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।

মামলা বৃত্তান্ত

২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হুসাইনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়। ওই অভিযোগ তদন্তকালে মোসলেম প্রধানের নাম আসে।

ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে ২০১৫ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার কামারহাটি গ্রাম থেকে মোসলেমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর দুইজনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। এ মামলায় সাক্ষী করা হয় মোট ৪৭ জনকে।

অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ৯ মে মোসলেম ও হুসাইনের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ৭ মার্চ ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে।

ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। আসামিদের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার পালোয়ান।