হাওরে ফসলহানি: বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির বিচার দাবি

হাওরে ‘অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে কর্মসূচি নেওয়ার কারণে’ বাঁধ ভেঙে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর পেছনের দুর্নীতিবাজদের কোনো বিচার হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2017, 01:43 PM
Updated : 12 April 2017, 01:58 PM

বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওরের ফসল ও জনজীবন: সরকার ও জনগণের করণীয়’ শিরোনামে এক গোলটেবিল আলোচনায় একথা বলেন তিনি।

সলতানা কামাল বলেন, “হাওরে অত্যন্ত অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে কিছু কিছু কর্মসূচি সরকারিভাবে নেওয়া হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিতার মধ্যে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে সেইসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেখানে কাজ দেওয়া হচ্ছে না।

“যারা জবাবদিহিতার বাইরে থাকতে পারে, এরকম প্রতিষ্ঠানকে সেখানে কাজে লাগানো হয়। এর ফলে সেখানে কোনো অসুবিধা দেখা দিলে বা ব্যত্যয় ঘটলে তাদের ধরার মতো কারোই কোনো সুযোগ থাকে না।”

হাওরের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় হাওরাঞ্চলের স্থানীয় জনগণকেও বাইরে রাখা হয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, “যেখানে যখন কাজ শুরু হয়, স্থায়ী জনগণের যে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান- সেখানে তা লাগানো হয় না।

“দুর্ভাগ্যজনক হলেও স্বীকার করে নিতেই হয়, এর পেছনে যে প্রণোদনা থাকে, যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন তারা তাদের লাভটা দেখার চেষ্টা করে। যাদের মাধ্যমে তাদের লাভ হবে সেই তাদের দিয়েই কাজটা করানো চেষ্টা করা হয়। যার ফলে এসব কাজের মধ্যে যেসব দুর্নীতি হয়।”

ওইসব দুনীর্তি চিহ্নিত হয় না অভিযোগ করে সুলতানা কামাল বলেন, “চিহ্নিত হলেও সেই দুর্নীতির বিচার আমরা দেখতে পাই না। এ মানুষগুলো বিচারহীনতার মধ্যে বাস করে, আইনের উপরে থাকে। তারা জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে না।”

গোলটেবিল আলোচনার সিদ্ধান্ত জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, “হাওরে যেসব কাজের জন্য টাকা যায়, সেই টাকার সুষ্ঠু হিসাব থাকা দরকার। সেখানে দুর্নীতি যাতে কোনোভাবেই প্রভাব ফেলতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে; এটা আমাদের দাবি।”

দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “যারা দুর্নীতি করছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচার করা হোক। যদি একটা বা দুইটাও এ ধরনের দুর্নীতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, তাহলে অনেকটাই এ ধরনের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যাবে।

“আমাদের একটা কথা বারবার বলছি, বলতে বলতে হয়রান হয়ে গেছি; সেটা হল- দুর্নীতি আমরা কমাতে পারি না, কারণ দুর্নীতি চিহ্নিত হয় না; চিহ্নিত হলেও সেটার বিচার হয় না। যারাই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত, প্রভাবশালী, যাদের দাপট আছে, দুর্বৃত্ত, তারা বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যায়। তাদের দুর্নীতির কোনো বিচার হয় না।”

কৃষকদের ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, “কৃষক কৃষি ঋণ নিলে যদি দিতে সমস্যা হয়, তখন কৃষকদের সার্টিফিকেট মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। কিন্তু যারা কোটি কোটি টাকার ঋণ খেলাপী, তাদেরকে বার বার সুযোগ দেওয়া হয়। তাদেরকেই সমাজে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।”

এ নীতিতে নিন্দা জানিয়ে এর একটা সংস্কারের দাবি জানান সুলতানা কামাল।

এছাড়া সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসেবে হাওরের কৃষকদের স্বার্থে সব কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার দাবি জানান তিনি।

সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ হাওর প্লাবিত হয়ে কৃষকের বোরো ধান তলিয়ে গেছে।

এতে শুধু নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায়ই কৃষক ২ কোটি ৫ লাখ মন ধান হারিয়েছে বলে বেসরকারি একটি সংগঠনের পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে।

দুর্বল ও অসমাপ্ত বাঁধ ভেঙে এ প্লাবন ও ফসলহানির ঘটনায় হাওরাঞ্চলের বাঁধ রক্ষায় বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার বলে গোলটেবিল বৈঠকে মন্তব্য করেন বেলার নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

তিনি বলেন, “২০০৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত হাওরে বাঁধ ভেঙে আটবার প্লাবিত হয়ে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে সরকার আইনগতভাবে বাধ্য। কিন্তু এই পর্যন্ত সরকার স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।”

হাওর রক্ষা বাঁধগুলো পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ ও যথাযথ সংস্কারের দাবি জানান তিনি।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্মের (এলএলআরডি) আয়োজনে বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা।

এতে অন্যদের মধ্যে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশান জাহান মনিসহ ক্ষতিগ্রস্ত হাওরাঞ্চলের কয়েকজন কৃষক বক্তব্য রাখেন।

অন্যদিকে হাওরের দুর্গতি নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বুধবার এক মানববন্ধনে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “হাওরে কোথাও বাঁধ আছে, আবার বাঁধ নেই। সেখানে বাঁধ নষ্ট হয়ে যায়, ভেঙে যায়।

“সবাই বলে, ঠিক করেন; বলছে কৃষকদের দুর্গতি লাঘব করেন। কিন্তু এই বিষয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই।”

পানি শাসন ব্যবস্থা না থাকার কারণে হাওর এলাকার কত শত বা কত হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তার হিসেব বের করতে নাগরিক আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ যুব ঐক্য পরিষদ এ মানববন্ধনের আয়োজন করে।