সুইডিশ রেডিওতে ‘র‌্যাব কর্মকর্তার বয়ানে’ ক্রসফায়ারের ব্যবচ্ছেদ

বাংলাদেশের এলিট বাহিনী র‌্যাব কীভাবে ‘ক্রসফায়ারের নামে’ মানুষ হত্যা করে, তা ওই বাহিনীর ‘উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার’ বয়ানে তুলে ধরেছে সুইডিশ রেডিও।  

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2017, 12:27 PM
Updated : 5 April 2017, 02:00 PM

সাড়ে আট মিনিটের একটি প্রতিবেদনে সুইডিশ রেডিও জানিয়েছে, ওই র‌্যাব কর্মকর্তার অজান্তে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়। সেখানে র‌্যাবের নির্যাতন, হত্যা ও গুমের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেন তিনি।  

ক্রসফায়ারের বিষয়ে র‌্যাব সদস্যদের কী নির্দেশনা দেওয়া থাকে- সে বিষয়ে বাংলায় ওই ব্যক্তির বক্তব্য দিয়ে শুরু হয়েছে সুইডিশ রেডিওর অডিও প্রতিবেদন। ওই বক্তব্যের একটি ইংরেজি তর্জমাও সুইডিশ রেডিওর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। 

সেখানে বলা হয়েছে- ‘ধরতে পারলে গুলি করে মেরে ফেল। পরে লাশের পাশে অস্ত্র রেখে দাও’- এমন নির্দেশনাই র‌্যাব সদস্যদের ওপর থাকে।

ওই কর্মকর্তার পরিচয় প্রকাশ না করে সুইডিশ রেডিও বলেছে, তিনি নিজেও এরকম ডজনখানেক হত্যায় সম্পৃক্ত ছিলেন। যারা বড় ধরনের অপরাধী, যাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কঠিন অথবা সংশোধন অসম্ভব বলে র‌্যাব মনে করে, তাদেরই এভাবে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। কখনও কখনও এ পদ্ধতি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও ব্যবহার হয়।  

এলিট পুলিশ কীভাবে অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে সেই টাকায় অস্ত্র কেনে, ‘র‌্যাব আত্মরক্ষার জন্য গুলি ছুড়েছে’- এটা বোঝানোর জন্য ‘ক্রসফায়ারে’ নিহতের পাশে কীভাবে সেই অস্ত্র ফেলে রাখা হয়- তার বিবরণও ওই ব্যক্তি দিয়েছেন বলে সুইডিশ রেডিওর ভাষ্য।

২০০৪ সালে পুলিশের অধীনে একটি এলিট বাহিনী হিসেবে যাত্রা শুরুর পর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে হত্যার অভিযোগ কখনোই র‌্যাবের পিছু ছাড়েনি। সংবাদপত্রগুলোতে নিয়মিতভাবে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধের’ খবর আসছে এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে থাকছে র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যার খতিয়ান। 

র‌্যাব কী করে টাকার বিনিময়ে গুপ্তহত্যায় জড়িয়ে পড়ছে- তার বিশদ বিবরণ উঠে এসেছে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার বিচারে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে র‌্যাব ভেঙে দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।

তবে সরকার সবসময়ই বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। সুইডিশ রেডিওর প্রতিবেদনের বিষয়েও একই কথা বলেছেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।

বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, র‌্যাব সবসময় ‘আইন মেনে’ কাজ করে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, ডাকাত দলের সদস্যদের ধরতে অভিযান চালায়।

“সেখানে র‌্যাবকে উদ্দেশ্য করে গুলি চালালে আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। উভয়পক্ষের গোলাগুলিতে কেউ মারা যেতে পারে। বিভিন্ন অভিযানে র‌্যাবের কর্মকর্তারাও আহত হন, পঙ্গুত্ব বরণ করেন, এমনকি মারাও যান। র‌্যাব বিভিন্ন সময়ে বহু অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করেছে।”

মুফতি মাহমুদ বলছেন, সুইডিশ রেডিওর ওই প্রতিবেদনেই ‘অস্পষ্টতা’ রয়েছে।  

“র‌্যাবের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কথিত কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদটি প্রচার করা হয়েছে। সেই কর্মকর্তা যদি আসলেই এমন কিছু বলে থাকেন, তবে তাকেও আইনের আওতায় আনা উচিত। এছাড়া সংবাদটিতে বিভিন্ন ধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে। বিভিন্ন ভেইক টার্ম ব্যাবহার করা হয়েছে। র‌্যাবের ঈর্ষণীয় সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এটি একটি অপপ্রয়াস মাত্র।”

তবে সুইডিশ রেডিও বলছে, তারা ওই অডিও রেকর্ডের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে দেখেছে এবং বিশেষজ্ঞরা ওই ‘উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার’ বক্তব্য ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলেই মনে করছেন।

বাংলাদেশ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ‘বিশেষজ্ঞ’ ওলফ ব্লমকভিস্ট ওই রেডিও প্রতিবেদনে বলেন, বিগত বছরগুলোতে তারা এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা র‌্যাবের কর্মকাণ্ড নিয়ে যেসব তথ্য পেয়েছে, তার সঙ্গে ওই রেকর্ডে দেওয়া বিবরণ মিলে যায়।

“এত ঠাণ্ডাভাবে স্বাভাবিক কণ্ঠে এরকম ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বর্ণনা সেখানে দেওয়া হয়েছে যে শুনলে শিউরে উঠতে হয়। ওই রেকর্ডের সত্যতা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না। কিন্তু এটা অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিৎ।”

সেই কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে সুইডিশ রেডিওর প্রতিবেদনে বলা হয়, যখনই র‌্যাবের হাতে কেউ নিহত হন, বেশ কয়েকটি তদন্তের ব্যবস্থা হয়। সাংবাদিকদের সামনে কীভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে তা ‘কর্তৃপক্ষগুলো সমন্বিতভাবে’ ঠিক করে দেয়।

র‌্যাব হেফাজতে কীভাবে ‘প্রায় অন্ধকার ঘরে মানুষকে নগ্ন করে, হাতকড়া বেঁধে ঝুলিয়ে’ নির্যাতন চালানো হয়, সে বিবরণও ওই কর্মকর্তা দিয়েছেন বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।

ওই ব্যক্তির বিবরণ অনুযায়ী, তুলে নিয়ে গুমের ক্ষেত্রে তিনটি ‘জটিল’ অংশ থাকে। একজন ব্যক্তিকে তুলে নেওয়া, তাকে হত্যা করা এবং লাশ গায়েব করে দেওয়া। ‘টার্গেটকে’ হয়ত বলা হয় যে, নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে কোনো বন্ধুর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার সময় কখনও কথনও পায়ে কংক্রিটের ব্লক বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে তা ভেসে না ওঠে।

ওই কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “গুমের বিষয়ে সবাই অভিজ্ঞ না। আমাদের নিশ্চিত হতে হয় যে, পেছনে কোনো ক্লু ফেলে যাচ্ছি না। কোনো আইডি কার্ড যাতে পড়ে না যায়, আমাদের গ্লাভস পড়তে হয়, পায়ের ছাপ লুকানোর জন্য জুতার ওপর বাড়তি কভার লাগাতে হয়। এ ধরনের অপারেশনে আমরা ধূমপানও করি না।”

সুইডিশ রেডিও বলছে, এভাবে প্রতিদিনই মানুষ গুম হয় বলে ওই কর্মকর্তা তাদের জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে নিরপরাধ ব্যক্তিও থাকে, যে কেউ এভাবে নিহত হতে পারে।