বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সোয়াট ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ নামে এই অভিযান শুরু করেন বলে পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান জানিয়েছিলেন।
বৃষ্টির মধ্যেই অভিযান শুরুর পর বাগানঘেরা ওই বাংলো ধাঁচের বাড়ির দিক থেকে টানা গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গিয়েছিল।
সাড়ে ৭টার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেও অভিযান শেষ হয়নি বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন কামরুল।
রাত ১১টার দিকে র্যাবের শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক এএসপি মো. মাইনুদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আলোর স্বল্পতার কারণে অভিযানে আপাতত বিরতি দেওয়া হয়েছে, আলোর ব্যবস্থা করে অথবা ভোরে অভিযান পুনরায় শুরু হবে।”
কয়েক ঘণ্টার অভিযানের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি কোনো কর্মকর্তা।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পৌর শহরের বড়হাট এলাকার অন্য জঙ্গি আস্তানাও ঘিরে রেখেছেন।
বড়হাট এবং সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুরে ওই দুটি বাড়ি বুধবার ভোরে পুলিশ ঘিরে ফেলার পর থেকে সারাদিনই থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রায় ১৮ কিলোমিটার ব্যবধানে ওই দুই বাড়িরই মালিক লন্ডন প্রবাসী এক ব্যক্তি। দুই বাড়িতে নারী ও শিশুসহ জনা দশেক লোক রয়েছে বলে ধারণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
নিরাপত্তার স্বার্থে বড়হাটের বাড়ি ঘিরে পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড ও কুসুমবাগ এলাকা এবং খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন।
দুই এলাকাতেই সকাল থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে মাইকিং করে।
বিকালে নাসিরপুরের ওই বাড়ির কাছে সিটি করপোরেশনের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, মই, জেনারেটরসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে যেতে দেখা যায়, যেমনটা দেখা গিয়েছিল চট্রগ্রামের সীতাকুণ্ড ও সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় অভিযানের আগে।
পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াট ও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা কয়েকটি মাইক্রোবাসে করে বিকাল ৫টার আগে নাসিরপুরে পৌঁছান। তাদের একটি দল পরে বড়হাটে যান বলে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, এই অভিযানের জন্য সোয়াটই ‘যথেষ্ট’ বলে তিনি মনে করছেন। তবে প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হবে।
মৌলভীবাজেরর ওই দুই আস্তানায় ‘বড় কোনো জঙ্গি’ থাকতে পারে- এমন ধারণার কথা জানিয়ে কামাল বলেন, প্রাণহানি এড়াতে সিলেটে ‘অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে’ অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেনাবাহিনীকে।
“এখানে (মৌলভীবাজার) যদি প্রয়োজন হয়… আমরা চাই প্রাণহানী যেন না ঘটে, প্রাণহানি কমাতে যা করা প্রয়োজন তাই করব।”
যা যা জানা গেছে
>> সাইফুল ইসলাম নামে লন্ডন প্রবাসী এক ব্যক্তি ওই দুই বাড়ির মালিক। এর মধ্যে নাসিরপুরে কয়েক একর জমিতে টিনশেড বাড়িটি তাদের গ্রামের ভিটা। আর শহরের বড়হাট আবুশাহ দাখিল মাদ্রাসা গলিতে ডুপ্লেক্স দালানটি তোলা হয় পরে।
>> সাইফুল বিদেশে থাকায় তার দুই বাড়ি দেখভাল করেন সাইফুলের আত্মীয় জুয়েল। তিনি পরিবার নিয়ে নাসিরপুরে ওই বাড়ির সঙ্গেই থাকেন।
>> জুয়েলের তথ্য অনুযায়ী, মাহফুজ নামের টাঙ্গাইলের এক ব্যক্তি বেসরকারি একটি কোম্পানির চাকুরে পরিচয় দিয়ে তিন মাস আগে নাসিরপুরের বাসাটি ভাড়া নেন। আর বড়হাটের বাড়ির ভাড়াটের নাম বেলাল। তিনিও একটি বেসরকারি কোম্পানির ব্যবস্থাপক পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেন।
>> স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন,শহরের বাড়িতে ৩/৪ জন এবং নাসিরপুরের বাড়িতে আরও দু’চারজন বেশি থাকতে পারে বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছেন তারা। আর নাসিরপুরের আস্তানায় দুই নারী, একজন শিশুসহ কমপক্ষে পাঁচজন থাকার তথ্য পাওয়ার কথা বলেছেন র্যাবের শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক এএসপি মাইনুদ্দীন।
>> জনমনে ‘ভীতি সঞ্চার ও নিরাপত্তাহীনতা’ এড়াতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান সরাসরি সম্প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পুলিশ সদরদপ্তর।
যেভাবে শুরু
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপ কমিশনার মহিবুল ইসলাম জানান, সীতাকুণ্ড ও সিলেটে জঙ্গি আস্তানার খোঁজ মেলার পর তদন্তে মৌলভীবাজারের এই দুই বাড়ির তথ্য পাওয়া যায়।
এর মধ্যে বড়হাটের ওই বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায় মঙ্গলবার রাতে। পরে ভোরের দিকে নাসিরপুরের বাড়িটির খোঁজ পাওয়া যায়।
“সরকার বাজারের ওই বাসায় যাওয়ার পর ভেতর থেকে গ্রেনেড ও গুলি ছোড়া হয়। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে।”
একই ঘটনা ঘটে বড়হাটের অন্য জঙ্গি আস্তানায়। দুটি বাড়ি ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই অভিযানের মধ্যেই দিনভর থেমে থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যায়।
উপ কমিশনার মহিবুল ইসলাম বলেন, সকালের দিকে তারা দুই আস্তানার ভেতরে থাকা সন্দেহভাজন জঙ্গিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা সাড়া দেয়নি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তারা ভেতর থেকে গুলি ছোড়ে এবং গ্রেনেড ফাটায় বলে মৌলভীবাজারের পৌর মেয়র ফজলুর রহমান বড়হাটে সাংবাদিকদের জানান।
এদিকে জঙ্গি আস্তানার এলাকাগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুৎ বন্ধ রাখায় ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পরিবার নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে বাড়ির ভেতরে সময় কাটছে তাদের।
তিন সপ্তাহে ৭ জঙ্গি আস্তানায় অভিযান
৭ মার্চ চট্টগ্রামের মিরসরাই এবং ১৫ মার্চ সীতাকুণ্ডের দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর গত ২৩ মার্চ গভীর রাতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে আতিয়া মহল নামের এক বাড়ি ঘিরে একইভাবে অভিযান শুরু করে পুলিশ। পরে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা শনিবার সকালে শুরু করেন চূড়ান্ত অভিযান- ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’।
ওই অভিযান শেষে আতিয়া মহলের ভেতরে এক নারীসহ চার জঙ্গির লাশ পাওয়া যায়। এর মধ্যেই ওই বাড়ির এক কিলোমিটারের ভেতরে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন।
মঙ্গলবার রাতে সেনাবাহিনী অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার পর ১২ ঘণ্টা পার না হতেই পাশের জেলা মৌলভীবাজারে নতুন অভিযান শুরু হয়।
এদিকে দুপুরে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে আরও একটি বাড়ি জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে ফেলে কাউন্টার পুলিশের টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা। সেখানেও সোয়াট পৌঁছানোর অপেক্ষা চলছে।
তবে বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন থাকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ভোটের পর সেখানে অভিযান হবে।