সাতক্ষীরার ৪ ‘রাজাকারের’ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে ট্রাইব্যুনালে

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেক মণ্ডলসহ সাতক্ষীরার চার আসামির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2017, 02:14 PM
Updated : 20 March 2017, 02:14 PM

চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়ে আগামী ২০ এপ্রিল আদেশের জন্য দিন রেখেছে বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ সোমবার উপস্থাপনের পর ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেয়।

ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। সঙ্গে ছিলেন রেজিয়া সুলতানা চমন।

এসময় আসামি আব্দুল খালেক মণ্ডলের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন এবং আসামি আব্দুল্লাহ হেল আল-বাকীর আইনজীবী এম আবদুর রউফ ও আব্দুস সাত্তার পালোয়ান উপস্থিত ছিলেন।

চার আসামির মধ্যে খালেক মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয় তদন্তকালেই। গত ৮ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর শতবর্ষী আব্দুল্লাহ হেল আল-বাকীকে শনিবার গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে রোববার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীর হেফাজতে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়া হয় এ আসামিকে।

বয়স বিবেচনায় ১০৩ বছর বয়সী বাকীকে জামিন দেওয়া হয়েছে বলে রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন প্রসিকিউটর চমন।

বাকি দুই আসামি খান রোকনুজ্জামান ও জহিরুল ইসলাম ওরফে টিক্কা খান পলাতক।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি আব্দুল্লাহ-হেল আলী বাকীসহ চারজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়।

এ মামলায় ২০১৫ সালের ৭ অগাস্ট তদন্ত শুরু হয়। প্রায় দেড় বছর পর এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। তদন্তকালে ৬০ জনের জবানবন্দি গ্রহণ করা হলেও মামলার সাক্ষী করা হয়েছে ৩৩ জনকে।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঁচ ব্যক্তিকে জবাই ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার অভিযোগে সাতক্ষীরা সদর আসনে জামায়াতের সাবেক সাংসদ আব্দুল খালেক মণ্ডলসহ নয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ২ জুলাই একটি মামলা করেন সদর উপজেলার শিমুলবাড়িয়া গ্রামের শহীদ রুস্তম আলী গাজীর ছেলে নজরুল ইসলাম গাজী। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খলিলনগর মহিলা মাদ্রাসায় বসে সহযোগীদের নিয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৬ জুন খালেক মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই বছরের ২৫ অগাস্ট তাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

সাত অভিযোগ

অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ১৮ অগাস্ট সকাল ৮টার দিকে বুধহাটা খেয়াঘাটে বেতনা নদীর পাড়ে আফতাবউদ্দিন ও সিরাজুল ইসলামকে রাজাকার কমান্ডার ইছাহাক (মৃত) ও তার সহযোগীরা গুলি করে হত্যা করে। পরে স্থানীয় খলিলুর রহমান, মো. ইমাম বারী, মো. মুজিবর রহমান ও ইমদাদুল হককে রাজাকার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র ডায়মন্ড হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগ-২: ১৯৭১ সালেরর পহেলা ভাদ্র ধুলিহর বাজার থেকে কমরউদ্দিন ঢালী নামের একজনকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায় ১০/১২ জন রাজাকার সদস্য। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সাতক্ষীরা মহকুমার রাজাকার কমান্ডার এম আব্দুল্লাহ-হেল আল বাকী ও খান রোকনুজ্জামান। পরে ঢালীর মৃতদেহ পাওয়া যায় বেতনা নদীর পাড়ে।

অভিযোগ-৩: ১৯৭১ সালের পহেলা ভাদ্র বুধবার বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে রাজাকার কমান্ডার বাকী, রোকনুজ্জামান খানসহ ৪-৫ জন মিলে সবদার আলী সরদারকে চোখ বেঁধে পিকআপ ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। পরে আর তার সন্ধান মেলেনি।

অভিযোগ-৪: সোহেল উদ্দিন সানা নামের এক ব্যক্তি তার বড় ছেলে আব্দুল জলিল সানাকে সঙ্গে নিয়ে পহেলা ভাদ্র বুধহাটা বাজার অতিক্রম করার সময় রাজাকার কমান্ডার ইছাহাক (মৃত) ও তার সঙ্গী রাজাকারদের হাতে আটক হন। পরে তাদের ডায়মন্ড হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সোহেল ও সানার সন্ধান আর মেলেনি।

অভিযোগ-৫: ১৯৭১ সালে ৭ আষাঢ় সকাল ৭টার দিকে আবুল হোসেন ও তার ভাই গোলাম হোসন নিজেদের বাড়ির পাশে হালচাষ করছিলেন। সকাল ৯টার দিকে গোলাম হোসেন বাড়িতে নাস্তা খেতে এলে আসামি আব্দুল খালেক মণ্ডল ও জহিরুল ইসলাম টিক্কা খানসহ ১০/১২ জন রাজাকার সদস্য এসে তাকে পাশের পাটক্ষেতে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

অভিযোগ-৬: ১৯৭১ সালের ২ ভাদ্র সকালে বাশদহ বাজারের ওয়াপদা মোড় থেকে মো. বছির আহমেদকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর তার বুড়ো আঙ্গুলের রগ কেটে দেয় রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।

অভিযোগ-৭: ১৯৭১ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে আসামি আব্দুল খালেক মণ্ডল ও রাজাকার কমান্ডার জহিরুল ইসলাম টিক্কা খান একদল পাকিস্তানি সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে কাথণ্ডা প্রাইমারি স্কুলে স্থানীয় গ্রামবাসীদের ডেকে মিটিং করে। সেই মিটিংয়ে বলা হয়, যারা আওয়ামী লীগ করে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তারা ‘কাফের’। এরপর তারা কাথণ্ডা ও বৈকারি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি-ঘর লুট করে জ্বালিয়ে দেয়।

সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই সদস্য মৃত গোলাম রহমানের স্ত্রী আমিরুনকে তার বাড়ির রান্নাঘরের পেছনে আটকে ধর্ষণ করে। এছাড়া বৈকারি গ্রামের ছফুরা খাতুনকে মৃত শরীয়তউল্লাহর ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে চার পাকিস্তানি সৈন্য।