যুদ্ধাপরাধের শতবর্ষী আসামিকে জামিন

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক ১০৩ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ-হেল বাকীকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকও সাতক্ষীরা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2017, 03:29 PM
Updated : 19 March 2017, 03:29 PM

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম আব্দুর রউফের হেফাজতে রোববার তাকে জামিন দেয় বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

জামিনের শর্ত অনুযায়ী, সাতক্ষীরার বাকীকে ঢাকায় থাকতে হবে এবং মামলার নির্ধারিত তারিখে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে হবে।

এর আগে ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা বিচারাধীন অবস্থায় বিএনপি নেতা আব্দুল আলীম ও সৈয়দ মোহম্মদ কায়সারকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়েছিল।

শারীরিকভাবে অসুস্থ বাকী শুক্রবার দুপুর থেকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের বুলারাটী গ্রামে তার বাড়িতে নজরদারিতে ছিলেন।

শনিবার রাতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে আম্বুলেন্সে চড়িয়ে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় নেয়। রোববার তাকে ট্রাইবুনালে হাজির করা হয়।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সাইদুর রহমান ও রেজিয়া সুলতানা চমন। চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার পালোয়ান।

প্রসিকিউটর চমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই মামলার চার আসামির মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেক মণ্ডল তদন্তকালেই গ্রেপ্তার হন। গত ৮ মার্চ বাকী, খান রোকনুজ্জামান ও জহিরুল ইসলাম ওরফে টিক্কা খানকে গ্রেপ্তারের আবেদন করলে ওই দিনই পরোয়ানা জারি হয়।

বয়স উল্লেখ করে আসামির আইনজীবী জামিন আবেদন করেছিলেন জানিয়ে এই প্রসিকিউটর বলেন, তখন আদালত উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে শর্ত সাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর করে।

সোমবার এ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। আসামি বাকীকে তখন ট্রাইব্যুনালে থাকতে হবে বলে জানান চমন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাকীসহ চারজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ মামলায় ২০১৫ সালের ৭ অগাস্ট তদন্ত শুরু হয়। প্রায় দেড় বছর পর এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। তদন্তকালে ৬০ জনের জবানবন্দি গ্রহণ করা হলেও মামলার সাক্ষি করা হয়েছে ৩৩ জনকে।

এ মামলার প্রধান আসামি সাতক্ষীরা সদর আসনে জামায়াতের সাবেক সাংসদ খালেক মণ্ডল।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঁচ ব্যক্তিকে জবাই ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার অভিযোগে খালেক মণ্ডলসহ নয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ২ জুলাই একটি মামলা করেন সদর উপজেলার শিমুলবাড়িয়া গ্রামের শহীদ রুস্তম আলী গাজীর ছেলে নজরুল ইসলাম গাজী। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুলনালে পাঠানো হয়।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খলিলনগর মহিলা মাদ্রাসায় বসে সহযোগীদের নিয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৬ জুন খালেক মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই বছরের ২৫ অগাস্ট তাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

সাত অভিযোগ

অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে বুধহাটা খেয়াঘাটে বেতনা নদীর পাড়ে আফতাবউদ্দিন ও সিরাজুল ইসলামকে রাজাকার কমান্ডার ইছাহাক (মৃত) ও তার সহযোগীরা গুলি চালিয়ে হত্যা করে। পরে স্থানীয় খলিলুর রহমান, মো. ইমাম বারী, মো. মুজিবর রহমান ও ইমদাদুল হককে রাজাকার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র ডায়মন্ড হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগ-২: ১৯৭১ সালের বাংলা ১ ভাদ্র তারিখে ধুলিহর বাজার থেকে কমরউদ্দিন ঢালী নামের একজনকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায় ১০/১২ জন রাজাকার সদস্য)। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সাতক্ষীরা মহাকুমার রাজাকার কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল বাকী ও খান রোকনুজ্জামান। পরে ঢালীর মৃতদেহ পাওয়া যায় বেতনা নদীর পাড়ে।

অভিযোগ-৩: ১ ভাদ্র বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে রাজাকার কমান্ডার বাকী, রোকনুজ্জামানসহ ৪-৫ জন মিলে সবদার আলী সরদারকে চোখ বেঁধে পিকআপ ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। পরে আর তার সন্ধান মেলেনি।

অভিযোগ-৪: সোহেল উদ্দিন সানা নামের এক ব্যেক্তি তার বড় ছেলে আব্দুল জলিল সানাকে সঙ্গে নিয়ে ১ ভাদ্র বুধহাটা বাজার অতিক্রম করার সময় রাজাকার কমান্ডার ইছাহাক (মৃত) ও তার সঙ্গী রাজাকারদের হাতে আটক হন। পরে তাদের ডায়মন্ড হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সোহেল ও সানার সন্ধান আর মেলেনি।

অভিযোগ-৫: ১৯৭১ সালে বাংলা ৭ আষাঢ় সকাল ৭টার দিকে আবুল হোসেন ও তার ভাই গোলাম হোসন নিজেদের বাড়ির পাশে হালচাষ করছিলেন। সকাল ৯টার দিকে গোলাম হোসেন বাড়িতে নাস্তা খেতে এলে আসামি খালেক মণ্ডল ও জহিরুল ইসলাম টিক্কা খানসহ ১০/১২ জন রাজাকার সদস্যব এসে তাকে পাশের পাটক্ষেতে ধরে নিয়ে গুলিতে হত্যা করে।

অভিযোগ-৬: ১৯৭১ সালের ২ ভাদ্র সকালে বাশদহ বাজারের ওয়াপদা মোড় থেকে মো. বছির আহমেদকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর তার বুড়ো আঙ্গুলের রগ কেটে দেয় রাজাকার বাহিনীর সদস্যশরা।

অভিযোগ-৭: ১৯৭১ সালের জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে খালেক মণ্ডল ও রাজাকার কমান্ডার জহিরুল ইসলাম টিক্কা খান একদল পাকিস্তানি সৈন্যলকে সঙ্গে নিয়ে কাথণ্ডা প্রাইমারি স্কুলে স্থানীয় গ্রামবাসীদের ডেকে বৈঠক করে। সেই বৈঠকে বলা হয়, যারা আওয়ামী লীগ করে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তারা ‘কাফের’। এরপর তারা কাথণ্ডা ও বৈকারি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি-ঘর লুট করে জ্বালিয়ে দেয়।

তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই সদস্য মৃত গোলাম রহমানের স্ত্রী আমিরুনকে তার বাড়ির রান্নাঘরের পেছনে আটকে ধর্ষণ করে। এছাড়া বৈকারি গ্রামের ছফুরা খাতুনকে মৃত শরীয়তউল্লাহর ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে চার পাকিস্তানি সৈন্য।