ডাকের অপেক্ষায় ‘কল-রেডী’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে ব্যবহৃত মাইক্রোফোনটি জাদুঘরে সংরক্ষণে রাখতে চায় বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী পুরান ঢাকার শব্দযন্ত্র সেবার প্রতিষ্ঠান কল-রেডী।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2017, 06:40 AM
Updated : 17 March 2017, 01:00 PM

বঙ্গবন্ধুর ৯৭ তম জন্মবার্ষিকীতে কল-রেডীর পরিচালক ত্রিনাথ ঘোষ সাগর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জাতির জনক যে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই মাইক্রোফোন ও স্ট্যান্ড যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন তার বাবা-কাকা । তারা চেয়েছিলেন সেই মাইক বঙ্গবন্ধুর হাতেই তুলে দিতে।

“তাদের সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এরপর আমরা নিজ উদ্যোগে সেগুলো সরকারের হাতে দেওয়ার কথা বলেছিলাম। কেউ আমাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। এখনও আমরা তা সংরক্ষণের জন্য দিতে চাই।”

গত সাত দশকে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে কল-রেডীকে। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ সভা-সমাবেশে সেবা দিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সূত্রাপুরের লক্ষ্মীবাজারের দুই সহোদরের হাতে ‘কল-রেডী’র গোড়াপত্তন। আরও দুই ভাই কাজে সহায়তা করতেন তাদের। দয়াল, হরিপদ, গোপাল ও কানাই ঘোষ- তাদের কেউ আর বেঁচে নেই।

হরিপদ ঘোষের চার ছেলে কল-রেডী দেখভাল করছেন এখন। এরমধ্যে ত্রিনাথ ঘোষ সাগর আছেন পরিচালক হিসেবে।

৩৫ বছর বয়সী সাগরের কাকা কানাই ঘোষ মারা গেছেন গেল বছর। বাবা হরিপদ ঘোষ গত হয়েছেন এক যুগ আগে। সহোদরদের সহায়তায় পারিবারিক ব্যবসাটি ধরে রেখেছেন সাগর।

যে মাইকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় মুক্তির ডাক দিলেন, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘোষণা দিলেন; সেই মাইকের প্রতি সরকারের দৃষ্টি চান পরিবারের সদস্যরা।

আরজু লাইট থেকে কল-রেডী

ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর দেশভাগের পর পর পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই তখন পরিবর্তনের হাওয়া।ইতিহাসের সেই নতুন অধ্যায়ের সূচনায় থান কাপড়ের পারিবারিক ব্যবসায় মন গেল না সূত্রাপুরের দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষের। ১৯৪৮ সালে তারা শুরু করলেন বাহারি বাতির ব্যবসা, নাম দিলেন আরজু লাইট হাউজ।

আলোকসজ্জার লাইটের পাশাপাশি গ্রামোফোন ভাড়া দিত লাইট হাউজ। বিয়ে-শাদী ও নানা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে লোকজনের আনাগোনায় অল্প সময়েই পরিচিতি পেয়ে যায় তাদের দোকান।

চাহিদা বাড়তে থাকায় ভারত থেকে কিছু মাইক নিয়ে আসেন দুই ভাই। যন্ত্রাংশ এনে হরিপদ নিজেও হ্যান্ডমাইক তৈরি করেন।

“দেশভাগের কিছু পরই নানা কারণে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। বাড়তে থাকে নেতাকর্মীদের মাইকের প্রয়োজন। পাশাপাশি নানা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাইকের চাহিদা থাকায় তারা তখন লাইট হাউজের নাম বদলের সিদ্ধান্ত নেন,” বলেন সাগর।

তিনি জানান, অনেক কিছু ভেবে দয়াল ঘোষ প্রতিষ্ঠানের নাম দেন কল-রেডী।

“তার যুক্তি ছিল, মানুষ তো কাজের জন্যই আমাদের মাইক ভাড়া নেয়। তারা কল করলে আমরা যেন রেডি থাকি, অর্থাৎ কল করলেই রেডি।”

এ ভাবনা থেকে জন্ম নেয় প্রায় ৬৭ বছরের পুরনো মাইকের প্রতিষ্ঠান-কল রেডী।

অবশ্য এ পরিবারেরই আরেক আত্মীয় ডা. সুব্রত ঘোষ ফেইসবুকে লিখেছেন, প্রথমেই ওই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘আই এম অলওয়েজ রেডি, অন কল এট ইয়োর সার্ভিস’, সংক্ষেপে আরজা (এআরজেএ) ইলেকট্রনিক্স। বছরখানেক পর নাম হয় কল-রেডী।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা

শুরুতেই ভালো সেবার সুনাম পাওয়ায় সভা-সমাবেশ ও বড় বড় অনুষ্ঠানে ডাক পড়তে থাকে কল-রেডীর।মাত্র ২০ জন লোক দিয়ে তখন কাজ চালাতেন হরিপদ ও দয়াল ঘোষ। তাদের সহায়তা করতেন অপর দুই ভাই গোপাল ঘোষ ও কানাই ঘোষ।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে কল-রেডী এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কণ্ঠ হয়ে ওঠে। 

এলো ৭ মার্চ

বাবা-কাকার স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে সাগর ঘোষ জানান, সাতই মার্চের আগে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ধানমণ্ডির বাসায় ডেকে পাঠান বঙ্গবন্ধু। তখনকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) জনসভার জন্য মাইক লাগাতে বলেন।

“সেদিন থেকেই কাজে নেমে পড়েন দুই ভাই। গাছে গাছে মাইক লাগিয়ে কারও যাতে নজরে না পড়ে সেজন্য সেগুলো ঢেকে দেন।”

সাতই মার্চের সেই জনসভায় কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ডাক- “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। জয় বাংলা।”

ত্রিনাথ ঘোষ সাগর বলেন, এতবড় মহাসমাবেশের মাইক সার্ভিসের জন্য পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করার সুযোগ তার বাবা ও জ্যাঠা মশাইয়ের ছিল না।

“বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন, এটাই ছিল বড় কথা। আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় বাবা শুধু খরচটাই নিতেন। এটা আমরা বাবার কাছ থেকেই শুনেছি।”

সেই মাইক্রোফোনের সামনে ‘আর কেউ না’

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীবাজারের সেই দোকানে ব্যস্ততাও বাড়ে। সে কথা স্মরণ করে তৃপ্তি যেমন আছে, তেমনি আক্ষেপও আছে সাগর ঘোষের।

“আজ গর্বে বুক ভরে যায়, যখন মনে হয় আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মাইকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। দেশের ইতিহাসের সঙ্গে কল-রেডী অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।”

তিনি জানান, সেই মাইক্রোফান আর মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড এখনও কল-রেডীর কাছে আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর কেউ সেই মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আর ভাষণ দেননি।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে যে মাইক্রোফেনের সামনে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেটিও ছিল কল-রেডীর।

আক্ষেপ করে সাগর বলেন, “বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন স্মৃতি চিহ্ন বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণের সেই মাইক্রোফোনের খোঁজ কেউ করেনি।”

তিনি বলেন, “এগুলো আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। সরকারের কেউ যোগাযোগ করলে এবং যথাযথ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলে আমরা তাদের হাতে তুলে দিতে চাই।”

বাংলাদেশের সংগ্রামের দিনগুলোতে ভূমিকার জন্য কল-রেডীর কোনো স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়েও আক্ষেপ আছে হরিপদ ঘোষের ছেলের।

“যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে তিনদিন ধরে কল-রেডী ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের জন্য মাইক সার্ভিস দিয়েছিল, সেজন্য হলেও কল-রেডী স্বীকৃতির দাবি রাখে। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আমরা এ বিষয়ে একটি আবেদন করেছি।”