‘নিয়ম না মানা আর গাফিলতিতে’ ফ্লাইওভার দুর্ঘটনা

রাজধানীতে নির্মাণাধীন মগবাজার ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ার জন্য এ ধরনের প্রকল্পে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের নিয়ম না মানার পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর তদারকির অভাবকে দায়ী করছেন প্রকৌশলীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকওবায়দুর রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2017, 04:14 PM
Updated : 13 March 2017, 04:38 PM

তারা বলছেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ঠিকমতো মেনে চলা হলেও প্রকল্পের কাজ চলার সময় নির্মাণশ্রমিক এবং পথচারীদের নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হয়।

রোববার রাতে রাজধানীর মালিবাগে নির্মাণাধীন মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে মারা যান স্বপন নামে একজন; আহত হয় নির্মাণকা্রী প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনসের প্রকৌশলীসহ দুজন।

এর আগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে মারা গিয়েছিলেন ১৩ জন। ওই ঘটনায় আহত হয়েছিল অনেকে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে ঠিকাদারকে বাধ্য করলে এসব দুর্ঘটনা অনেক কমানো সম্ভব বলে মনে করেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিটি বড় প্রকল্পেই হেলথ অ্যান্ড সিকিউরিটি ম্যানুয়াল থাকে। চুক্তিপত্রে লেখা থাকে, প্রকল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং আশপাশের লোকজনের নিরাপত্তা কীভাবে বিধান করবে। আমাদের বিল্ডিং কোডেও বলা আছে, সেফটির জন্য কী করতে হবে।

“কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো পালন করা হয় না। বেশিরভাগ প্রকল্পে কাজ করার সময়ই এগুলো ঠিকাদাররাও মানে না। কারণ তাদেরকে বাধ্য করা হয় না।”

এসব মানানোর দায়িত্ব প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার উপর দিয়ে বুয়েটের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, “কনট্রাকটরকে ফোর্স করতে হবে। এগুলো না মানলে আমি কাজ করতে দেব না- এটা বলতে হবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে।”

মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন।

এর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় যে দুর্ঘটনা ঘটে সেটি নির্মাণকাজে ছিল পারিশা এন্টারপ্রাইজ ও মীর আক্তার এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা হিসেবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

নিয়ম না মানায় বহদ্দারহাটের দুর্ঘটনা ঘটেছিল বলে অভিযোগ করেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (ইআইবি), চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেখানে ছুটির দিনে কাজ করার কথা ছিল না। এমনকি রাতেও কাজ করার কথা ছিল না। কিন্তু ছুটির দিনে রাতের বেলায় সেখানে গার্ডার উঠানো হচ্ছিল।”

ফ্লাইওভার নির্মাণকালে এসব দুর্ঘটনার পেছনে ঠিকাদারদের এই নিয়ম না মানার সঙ্গে তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিকেও দায়ী করে প্রকৌশলী দেলোয়ার বলেন, “ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না। দুর্ঘটনার পর তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়।

“ঠিকাদাররা স্বাভাবিকভাবেই ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নিয়োগকারী সংস্থাগুলো রাজউক, সিডিএ কিংবা এলজিইডি- সরকারি সব সংস্থার মধ্যেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। এ কারণেই নিরাপত্তার ফাঁকফোকরগুলো বড় হতে থাকে। এই ফাঁক দিয়েই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে।”

বড় প্রকল্পগুলোয় ‘সেফটি রেকর্ড’ রাখা জরুরি বলে মনে করেন এই প্রকৌশলী।

তিনি বলেন, “বড় প্রকল্পে প্রতি সপ্তাহে বৈঠকে নিরাপত্তা রেকর্ডগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। কোথাও যদি কোনো নিরাপত্তা ত্রুটি থাকে, শিথিলতা থাকে, সেগুলো উন্নত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

“সেফটি রেকর্ড দেখে প্রতি সপ্তাহে ব্যবস্থা নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু আমাদের এখানে কোথাও সে প্রক্রিয়া পালন করা হচ্ছে না।”

মালিবাগে গার্ডার দুর্ঘটনার পেছনেও নিরাপত্তা ত্রুটি ছিল বলে মনে করেন নগরবিদ দেলোয়ার।

“আমি কয়েকবার ওই ফ্লাইওভার নির্মাণ এলাকায় গিয়েছি। আমি দেখেছি, নিরাপত্তার বিষয়টি যথাযথভাবে করা হচ্ছে না। উপরে কাজ করার সময় সতর্কীকরণের জন্য নিচে কোনো সাইন থাকে না, কোনো মানুষ থাকে না। এমনকি যারা উপরে কাজ করছিল, তাদেরও সেফটি শু, সেফটি হেলমেট, বেল্ট পড়তে দেখিনি।”

নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন দাবি

মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ‘ভালো’ বলে দাবি করেন এর নির্মাণে থাকা প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঝুঁকি এড়াতে রাত ১২টার পর রাস্তা বন্ধ করে গার্ডার উঠানো হয়। পুরো রাস্তা বন্ধ করেই গার্ডার তোলা হয়, যেন তা পড়ে গেলেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি না ঘটে।

“রোববার রাতেও সেভাবেই কাজ করা হচ্ছিল। কিন্তু যে লোকটা মারা গেছে, সে কীভাবে এখানে এসে পড়ল? সেটা নাকি কেউ দেখেনি, কেউ টেরই পায়নি।”

দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া ছিল বলে দাবি করেন ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা আতাউর।

তিনি বলেন, “এটা খুব ক্রিটিকাল কাজ। এজন্য এখানে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার, এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারসহ সবাই ছিল। সব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

“আমরা তো প্রায় ১২ থেকে ১৪শ গার্ডার নিরাপদে উঠাইলাম। আসলে কীভাবে দুর্ঘটনা কখন ঘটে, কেউ জানে না। এটা আগে তোলা হয়েছিল, বসানো গার্ডার, এটা পড়ে যাওয়ার কথা না। এখন কেন পড়লো, আমরা তা বুঝতে পারছি না।”

এবিষয়ে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক নাজমুল আলম এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী শ্যামা প্রসাদ অধিকারীর মোবাইলে কল করা হলেও দুজনের কেউই ফোন ধরেননি।