‘নিবন্ধন ঝুঁকিতে’ ২১ দল

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিবন্ধন বাতিলের ধারা নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনীতির অঙ্গনে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2017, 05:19 AM
Updated : 2 March 2017, 06:24 AM

পরপর দুটি সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ অনুচ্ছেদের এইচ (১) ধারায়। এ অবস্থায় বিএনপিসহ ২১টি দলকে নিবন্ধন বাঁচাতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে।

এ বিষয়ে ইংগিত করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে ‘আন্দোলন বাদ দিয়ে’ একাদশ নির্বাচনের জন‌্য প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশনও সব দলকে ভোটে পাওয়ার আশার কথা বলেছে।

কিন্তু সিইসিকে ‘প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের লোক’ আখ‌্যা দিয়ে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না- সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।

২০০৮ সালে এটিএম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সময় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এ নিবন্ধনের নিয়ম চালুর পাশাপাশি কিছু শর্ত প্রতিপালনে ব‌্যর্থ হলে নিবন্ধন বাতিলের সুযোগ রাখা হয়।

শামসুল হুদার কমিশন দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধনের শর্ত দিয়ে ৩৯টি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয়। এর মধ‌্যে ৩৮টি দল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম সংসদের ভোটে অংশ নেয়।

এরপর ২০০৯ সালে সংসদে নিবন্ধন বিষয়ে আইনি সংশোধনী আনা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে অংশ নেয় ১২টি রাজনৈতিক দল।

দশম সংসদ নির্বাচনের ১২ দল

আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি-জেপি, বাংলাদেশ ন‌্যাশনালিস্ট পার্টি-বিএনএফ, বাংলাদেশ ন‌্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও গণতন্ত্রী পার্টি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়।

নবম সংসদের ভোটে ছিল আরও ২৭

মোট ৩৮টি দল অংশ নিয়েছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে। দশম সংসদের ১১টি (বিএনএফ ছাড়া) দলসহ আরও ২৭টি দল সেই ভোটে ছিল।

বাকি দলগুলো হল- বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, ইসলামী ঐক‌্যজোট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণ ফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশ কল‌্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, ন‌্যাশনাল পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ ন‌্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন‌্যাপ, ঐক‌্যবদ্ধ নাগরিক আন্দেোলন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ফ্রিডম পার্টি, বাংলাদেশের সাম‌্যবাদী দল (এম এল) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি।

নতুন তিন দল

শুরুতে নিবন্ধিত ৩৯ দলের মধ‌্যে সংশোধিত গঠনতন্ত্র দিতে না পারায় ২০০৯ সালে ফ্রিডম পার্টির এবং নিবন্ধনের শর্ত না মানায় আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৩ সালে জামায়াত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। এ দুটি দল নবম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

এরপর দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে নিবন্ধন পায় নতুন তিনটি দল। সব মিলিয়ে বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল রয়েছে ৪০টি।

নতুন তিন দল বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট) ও বাংলাদেশ ন‌্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) নিবন্ধন পাওয়ার পর কেবল দশম সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ফলে বাতিলের আলোচনায় এই তিন দল থাকছে হিসাবের বাইরে।

উপ নির্বাচনে বাঁচল খেলাফত

ইসিতে নিবন্ধিত দলগুলোর ভোটে অংশ নেওয়ার তথ‌্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, নবম সংসদের আগে ৩৯টি দল নিবন্ধিত হলেও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সেই ভোটে অংশ নেয়নি খেলাফত মজলিস। ৩৮ নম্বর দল হিসাবে দেওয়াল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে নিবন্ধিত পায় দলটি।

দলের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নবম ও দশম সংসদের সাধারণ নির্বাচনে আমরা অংশ নিইনি। এ কারণে দলের নিবন্ধন কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে আমাদের কাছে ইসি চিঠি দিয়েছিল। আমরা এর জবাব দিয়েছি।”

সেই জবাবে কমিশন ‘সন্তুষ্ট হয়েছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের নিবন্ধন বহাল রয়েছে বলে কমিশন থেকে জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে ইসির সহকারী সচিব রৌশন আরা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুটি সাধারণ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার তথ‌্য থাকায় খেলাফত মজসিলকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। দলটি জানিয়েছে, ২০০৯ সালে রংপুর-৩ এবং ২০১১ সালে হবিগঞ্জ-১ আসনের উপ নির্বাচনে তারা প্রার্থী দিয়েছিল।

“তাদের দেওয়া তথ‌্য পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে। উপ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাদের নিবন্ধন বাতিল হচ্ছে না।”

একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে তারপর নিবন্ধন বাতিলের প্রসঙ্গটি এ দলের ক্ষেত্রে উঠবে বলে জানান এ ইসি কর্মকর্তা।

একই পথে আরও চার দল

দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও পরে মৌলভীবাজার-৩ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ উপ নির্বাচনে অংশ নেয় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এনপিপি মাগুরা-১ ও টাঙ্গাইল-৪ উপ নির্বাচনে প্রার্থী দেয়। ইসলামী ঐক‌্যজোট ও বাংলাদেশ ন‌্যাপ অংশ নেয় ময়মনসিংহ-৩ উপ নির্বাচনে।

ফলে এই চার দলের জন‌্যও নিবন্ধন বাতিলের বিধি আপাতত মাথাব‌্যথার কারণ হচ্ছে না।

নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী পরপর দুই বার সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হবে। সাধারণ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে পরে যে কোনো উপ নির্বাচনে অংশ নিলেও নিবন্ধন থাকবে।

দশম সংসদে অংশ নেওয়া এক ডজন দল একাদশে অংশ না নিলেও নিবন্ধন নিয়ে তাদের ঝুঁকি থাকবে না। বাকি ২৫টি দলের মধ‌্যে চারটি উপ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ইতোমধ‌্যে ঝুঁকি এড়াতে পেরেছে। বাকি ২১টি দলকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত ধারার কথা মাথায় রাখতে হবে বলে ইসি কর্মকর্তারা মনে করছেন।

ঝুঁকিতে যেসব দল

বিএনপি, লিবারেল ডেমক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, গণ ফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশ কল‌্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, ঐক‌্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সাম‌্যবাদী দল (এম এল) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি।

ইসি সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন নিবন্ধনে আগ্রহী দলগুলোর জন‌্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। শর্ত পূর্ণ করলেই রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়া যাবে।

“ইসির সিদ্ধান্ত পেলে নতুন নিবন্ধনের বিষয়ে যথাসময়ে আবেদন চাওয়া হবে। আর এই মুহূর্তে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার মত অবস্থায় কোনো দল নেই। একটি দলের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছিল; তারা উপ নির্বাচনে যাওয়ায় নিবন্ধন বাতিল হয়নি।”

দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করা দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকি নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইসি সচিব বলেন, “একাদশ সংসদ নির্বাচন এখনও অনেক দূরে। সামনে উপ নির্বাচন রয়েছে। তাতেও অনেকে অংশ নিতে পারবে। সংসদ নির্বাচন পার না হওয়ার আগে আগাম কিছু বলা ঠিক নয়। যা হবে তা আইনেই রয়েছে, আইনানুগভাবে কমিশন কাজ করবে।”