বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন: কানাডীয় আদালত

হরতাল-অবরোধে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার কারণে দলটির এক কর্মীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন কানাডার আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।

শওগাত আলী সাগর কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Feb 2017, 04:19 PM
Updated : 23 Feb 2017, 09:38 AM

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, বিএনপি সন্ত্রাসে ছিল, আছে বা ভবিষ‌্যতেও থাকতে পারে- এমন ধারণা করার যৌক্তিক কারণ আছে।    

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় দুই দলের বৈরিতার ইতিহাস, হরতালের মত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংসতা, সরকারের লক্ষ‌্য অর্জন কঠিন করে তুলতে অর্থনৈতিক ক্ষতির কৌশল হিসেবে হরতালের ব‌্যবহার এবং তাতে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ‌্যমের প্রতিবেদন ও ইন্টারনেটের উন্মুক্ত তথ‌্য তুলে ধরে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছে কানাডার ফেডারেল আদালত।  

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে ২০১৫ সালের শুরু থেকে বিএনপির ডাকে টানা তিন মাসের হরতাল-অবরোধে ব‌্যাপক সহিংসতায় দেড় শতাধিক মানুষের মৃত‌্যু হয়। কানাডীয় আদালতের রায়ের পর দলটির কোনো নেতার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

মোহাম্মাদ জুয়েল হোসেন গাজী নামে ঢাকার মিরপুরের এক ব‌্যক্তি বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীর পরিচয় দিয়ে কানাডা সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন।

তার স্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাসের আবেদন ২০১৫ সালে প্রাথমিক অনুমোদন পেলেও গতবছর ১৬ মে তাকে ‘কানাডায় প্রবেশের অযোগ্য ঘোষণা’ করেন দেশটির অভিবাসন কর্মকর্তা।

ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কানাডার ফেডারেল আদালতে বিচারিক পর্যালোচনার আবেদন গত ২৫ জানুয়ারি খারিজ করে রায় দেন বিচারক হেনরি এস ব্রাউন।

অভিবাসন কর্মকর্তা তার সিদ্ধান্তে বলেছিলেন, আবেদনকারী জুয়েল হোসেন গাজী এমন একটি সংগঠনের সদস‌্য, যে দল ‘সন্ত্রাসে যুক্ত বলে মনে করার যৌক্তিক কারণ আছে’। সুতরাং কানাডার ইমিগ্রেশন অ‌্যান্ড রিফিউজি প্রোটেকশন অ‌্যাক্টের (আইআরপিএ) ৩৪(১) এর এফ ও সি ধারা অনুযায়ী তিনি সুরক্ষা পাওয়ার জন‌্য কানাডায় বসবাসের স্থায়ী অনুমতি পাওয়ার যোগ‌্য নন।

কানডার আইনের ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব‌্যক্তি যদি এমন কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, যে সংগঠন সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল, আছে বা ভবিষ‌্যতে থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে, তাহলে তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে কানাডায় প্রবেশের অনুমতি পাবেন না।  

জুয়েল গাজীর জুডিশিয়াল রিভিউ আবেদনের শুনানি করে অভিবাসন কর্মকর্তার সিদ্ধান্তই সঠিক বলে রায় দেয় ফেডারেল আদালত।

রায়ে বলা হয়, কানাডার আইনে (আইআরপিএ) বর্ণিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল কী না- সে প্রশ্ন এ মামলার অভিবাসন কর্মকর্তাকে বিবেচনা করতে হয়েছে।

“সতর্কতার সঙ্গে বিস্তারিত পর্যালোচনার পর ওই কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, কানাডার আইন অনুযায়ী ‘বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল বা আছে’ বলে মনে করার যৌক্তিক কারণ আছে।”

সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার আবেদনে জুয়েল গাজী দাবি করেছিলেন, বিএনপি সন্ত্রাসকে ‘প্রশ্রয় দেয় না’ এবং দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করায় কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব‌্যবস্থা নেওয়ারও নজির রয়েছে।

কিন্তু অভিবাসন কর্মকর্তার তুলে ধরা লাগাতার হরতাল ও সহিংসতার বিবরণ তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে আবেদনকারীর যুক্তি ‘হারিয়ে যায়’।      

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে নাশকতার কয়েকটি মামলায় আসামি করা হয়

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়, বিএনপি নেতৃত্ব একবারই এক বাক‌্যে সন্ত্রাসের নিন্দা করেছেন, যখন বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে সাতজন ঘুমন্ত মানুষকে হত‌্যার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বিএনপি তাদের কর্মীদের সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে- এমন আর প্রমাণ আদালতের সামনে আসেনি।

অভিবাসন কর্মকর্তার যুক্তি থেকে উদ্ধৃত করে বিচারক তার রায়ে বলেন, বাংলাদেশের একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে এমন একটি ভাবমূর্তি বিএনপির কাম‌্য হওয়ার কথা নয়, যাতে মনে হয় যে দলটি অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পরিকল্পিতভাবে সংঘাত ও সহিংসতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু বিএনপির লাগাতার হরতাল এবং তাতে অব্যাহত সহিংসতা এই বিশ্বাস জাগায় যে, নিজেদের কর্মীদের সহিংসতা থেকে না সরিয়ে দলটি কেবল কৌশল হিসেবে হরতালে সহিংসতার নিন্দা করেছে।

আবেদনকারী যুক্তি দিয়েছিলেন, কানাডার সরকার বিএনপিকে সন্ত্রাসী দলের তালিকাভুক্ত করেনি। রায়ে আদালত বলেছে, কানাডার গভর্নর কাউন্সিল তালিকাভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় জড়িত থাকে। সরকার তালিকাভুক্ত করেনি বলে অভিবাসন কর্মকর্তা আইন অনুযায়ী নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না- তেমন কোনো যুক্তি আবেদনকারী দেখাতে পারেনি।

২০১৫ সালে বিএনপির তিন মাসের অবরোধ-হরতালে প্রতিদিন বহু যানবাহন নাশকতার শিকার হয়

বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন নয়- যুক্তরাষ্ট্রের আদালত এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছে বলেও বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন আবেদনকারীর আইনজীবী। কিন্তু দুই দেশে ‘সন্ত্রাসবাদ’ এর সংজ্ঞার পার্থক‌্যের বিষয়টি তুলে ধরে ফেডারেল আদালত তা নাকচ করে দেয়।   

অভিবাসন কর্মকর্তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে রায়ে বিচারক বলেন, “ওই কর্মকর্তা বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি ‘সহিংস বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমিও দেখতে পাচ্ছি, বিএনপি ও ক্ষমতাসীন দল (আওয়ামী লীগ)- দুই পক্ষের সমর্থকরাই জনমত প্রভাবিত করতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সহিংসতায় জড়িয়েছে।

“কিন্তু দল দুটির এই পারস্পরিক  অসদাচারণ বিএনপিকে আইআরপিএ অনুযায়ী ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচেনা করা থেকে দায়মুক্তি দিতে পারে বলে আমি মনে করি না। যে কারণে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ বিএনপি কর্মীদের কানাডায় প্রবেশের আবেদন নাকচ করতে পারে, তা ওই যুক্তি খণ্ডাতে পারে না।”