ষাটের দশকে স্কুল পড়ুয়া মিনা পালের বাংলা চলচ্চিত্রের ‘কবরী’ রূপে আত্মপ্রকাশ, উত্তাল একাত্তরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ভারতের বড় বড় শহরে জনমত সংগঠন, সেলুলয়েডের বাইরে রাজনীতি জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতি দুই মলাটে বেঁধে কিংবদন্তী এই অভিনেত্রী প্রথমবারের মত একুশের বইমেলায় আসছেন লেখক পরিচয় নিয়ে।
‘স্মৃতিটুকু থাক’ শিরোনামে কবরীর এই আত্মজৈবনিক রচনায় ঢাকাই সিনেমার সদর-অন্দরের পাশাপাশি এই শিল্পের উপর যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির অভিঘাতের কথাও উঠে এসেছে।
বিপিএলের একজন মুখপাত্র বলেন, এই বইয়ে থাকছে কবরীর “অপ্রকাশিত কিছু ছবি আর অজানা কিছু গল্প,” যার প্রথম চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৪ সালে।
সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবিতে অভিষেক; এর পর অর্ধশতকে দুই শতাধ্কি সিনেমায় আলো ছড়িয়েছেন কবরী। শীর্ষ পাঁচ ঢাকাই নায়কের অভিষেক ঘটেছে তার হাত ধরেই।
বই লেখা প্রসঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কবরী বলেছেন, “আমার কিছু অজানা কথা আপনাদের জানানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করেছি।”
সুতরাংয়ের সেটে প্রথম শটেই চড় খেয়ে কেঁদে ভাসানোর গল্প যেমন প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা বইটিতে থাকছে, তেমনি থাকছে কিশোরী মনে প্রথম কারও জন্য ‘প্রেম প্রেম অনুভূতি’ হওয়ার কথা।
ঢাকাই ছবির ইতিহাসে রাজ্জাক-কবরী জুটির আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার রসায়ন আর কবরীর জীবনে বাস্তবের রাজ্জাকও ধরা পড়েছেন এই স্মৃতিকথায়।
কবরী লিখেছেন, “এক সাথে কাজ করেছি অনেক ছবিতে- বন্ধুত্ব হবারই কথা, হয়েওছে। কিন্তু রাজ্জাক সাহেব বরাবরই আমাকে হিংসে করেন। আমি করতাম কিনা জানি না। আমি তাকে বন্ধুর পরও আরও এক ধাপ এগিয়েই রেখেছিলাম।”
‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘অনির্বাণ’, ‘দীপ নেভে নাই’সহ অর্ধশতাধিক সিনেমার এই জুটিকে পরে ‘আমাদের সন্তান’ চলচ্চিত্রে বয়স্ক বাবা-মায়ের ভূমিকাতেও দর্শকরা দেখেছেন।
“ভালো লাগতে লাগতেই তো ভালোবাসা হয়, অভিনয় করতে করতে যদি ভালোবাসা না-ই হয় তাহলে মানুষের মনে ভালোবাসা তৈরি হবে কী করে? সিনেমামোদী যারা এসব সিনেমা দেখেছেন তারাও হয়ে যেতেন রাজ্জাক আর অপরপক্ষ নিজেকে ভাবত কবরী, তাই না?”
১৯৭৩ সালে ‘রংবাজ’ সিনেমায় দর্শক এক লাস্যময়ী কবরীকে আবিষ্কার করে। সেই চলচ্চিত্রের ‘সে যে কেন এল না, কিছু ভালো লাগে না’ গানটি এখনও বহু দর্শকের বুকে বাজে।
অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে পার করে আসা এই অভিনেত্রী লিখেছেন, “আমার কপালে প্রেমের সুখ কোনোদিন হয়নি। যাক আপদ চুকেছে। প্রেমে পড়ে কার না কার ঘরনী হতাম। তবে যা হবার তা তো হয়েইছে। সবার জীবন কি এক রকম হয়? এই পৃথিবী একটা যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধে কেউ জেতে কেউ হারে- মেনে নিতেই হয়। এভাবেই বুঝি জীবন কেটে যায়।”
চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গী বাজারের কিশোরী মিনা পালের স্বপ্ন ছিল- “বড় হয়ে সাদা শাড়ি পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে মাস্টারি করবে”। কিন্তু ‘লাইট-অ্যাকশন-কাটের’ পর রাজনীতিতে নেমে জীবনের আরেক চলচ্চিত্রের মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছে বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে।
‘স্মৃতিটুকু থাক’ ধারণ করেছে কবরীর সেই সময়ের কথাও। এসেছে ভোটের মাঠে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা, এক সময় যে পরিবারের বধূ ছিলেন তিনি। সব জয় করেই কবরী নবম সংসদে আওয়ামী লীগের সাংসদ হয়েছিলেন।
২০০৬ সালে মুক্তি পায় কবরীর পরিচালার প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’। সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি।
তার প্রথম বইয়ের ভূমিকায় কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, “কিংবদন্তীতুল্য চিত্রনায়িকা কবরীর লেখা আত্মজীবনী ‘স্মৃতিটুকু থাক’ -এর পাণ্ডুলিপি পাঠ করে আমার মনে হলো, আমি কোনো কবির রচিত আত্মজৈবনিক গদ্য পাঠ করছি।”
আঙ্গিকে নতুনত্ব ও বিষয়ে বৈচিত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুই বছর আগে আত্মপ্রকাশ করা বিপিএল এবার একুশে বইমেলায় আনছে একডজন বই।
বিপিএল মুখপাত্র জানান, শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর নিয়ে ‘সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ ও ইসলাম’, কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর স্মৃতিকথা ‘পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে’, সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীরের প্রবন্ধ সংকলন ‘অস্থির রাজনীতি’, ব্লগ সংকলন ‘নগর নাব্য’ এবার নতুন এসেছে মেলায়।
এছাড়া হায়াৎ মামুদের অনুবাদ, ভূমিকা ও টিকাসহ হুমায়ুন কবিরের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এবার বিপিএল থেকে পুনর্মুদ্রণ হয়েছে।
স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের লেখা নৃবিজ্ঞানের বিখ্যাত বই 'গোল্ডেন বাউ' এর একটি পরিমার্জিত সংস্করণ আসার কথা রয়েছে এবারের মেলায়।
আরও আসছে আনিসুর রহমান স্বপনের ‘পারস্যে রবীন্দ্রনাথ’, আলোকচিত্রের ষোল দিকপালের সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘প্রীত রেজার মুখোমুখি’, মুস্তাফিজ মামুনের বন ভ্রমণের সচিত্র গাইড ‘বনে বেড়াই’, আর্টস ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত কয়েকটি লেখার সংকলন ‘রবীন্দ্রবিতর্ক বঙ্গভঙ্গ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং হোমিওপ্যাথি নিয়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘লক্ষণ সংহিতা’।
এবারের মেলার বাংলা একাডেমি অংশ ৬৫-৬৬ নম্বরে বিপিএলের স্টলে পাওয়া যাবে বইগুলো। এছাড়া যে কোনো সময় বিপিএলের ওয়্সোইটে গিয়ে বই অর্ডার করা যায়। দেশের অভিজাত বইয়ের দোকানগুলোতেও বিপিএলের বই পাওয়া যায় বলে মুখপাত্র জানান।