বইমেলায় ছুটির ভিড়

কর্মব্যস্ত সপ্তাহ শেষে ছুটি মিলেছে, ধকল শেষে প্রিয় বইয়ের খোঁজে মেলায় ছুটে এলেন তরুণ চাকুরে। তার হাত ধরে চলে এল চপলা কিশোরী, এল দুরন্ত ছেলেটিও।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2017, 04:05 PM
Updated : 17 Feb 2017, 05:16 PM

শুক্রবার একুশে বইমেলার সতেরতম দিনে এমন শত শত মানুষের ভিড়ে মেলা প্রাঙ্গনে ছিল না তিলধারণের ঠাঁই।

মেলায় আসা তরুণ ব্যাংক কর্মকর্তা উৎপল সমাদ্দার বলেন, “কাজের যত চাপই থাকুক, মেলায় আসতেই হবে। প্রিয় লেখকের বই খুঁজেছি, খুঁজছি প্রিয় লেখককে, যদি কারও দেখা পাই। আর মেলায় এসে কেমন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।”

শুক্রবার সকালে ছিল শিশুপ্রহর। মা জয়া আহমেদকে নিয়ে রাজধানীর সেনপাড়া পর্বতা থেকে চলে এসেছিল রাইসা। রাইসার ভালো লাগে কমিকস, পাশাপাশি সে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গল্পও ভীষণ ভালোবাসে।

পছন্দের সবগুলো বই কিনে নিয়ে যাওয়ার পথে রাইসলা বলল, “মা আমাকে সবসময় বই উপহার দেয়। আমি স্কুলের পড়া শেষ করে বই পড়ি। বন্ধুরা প্রায় আমার কাছে এসে বই ধার চায়।”

বেসরকারি চাকরিজীবী আলতাফ হোসেন এসেছিলেন তার ভাইয়ের মেয়ে বিপাশা আর ছেলে অনিককে নিয়ে। অনিক সায়েন্স ফিকশন কিনেছে, আর বিপাশা কিনেছে উপন্যাস।

আলতাফ হোসেন বলেন, “বিকালে ভীষণ ভিড় লেগে থাকবে। সকালে এসে পছন্দের বইগুলো কিনে নিল ওরা।”

স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী বিপাশা বলেন, “উপন্যাসই বেশি পড়ি। পড়ার ফাঁকে সুনীল, সমরেশ বা মানিক বন্দোপাধ্যায়- আমাকে ভীষণ চাঙ্গা করে তুলে। জীবনের কত গল্প খুঁজে পাই সেখানে।”

বইমেলার মৌসুমে প্রতিবারই ঢাকা আসে রাজশাহী কলেজের ছাত্রী আদৃতা হোসেন। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা, ভীষণ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তার। তবু ‘বইমেলার টানে’ তিনি ছুটে এসেছেন মামা জাকির হোসেন খানের সঙ্গে; রয়েছে তার মামাতো ভাই জোবায়ের হোসেনও।

আদৃতা ও জোবায়ের সারা বিকাল মেলায় ঘুরে কিনেছে জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন ও কিশোর উপন্যাস। পাশাপাশি তার খুঁজে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসমৃদ্ধ বইগুলোও।

বাবা মেহেদী আল মাহমুদের সঙ্গে এসে বিভোর খুঁজে গেল আঁকাবুকির বই।

মেলার ১৭তম দিনে পেরিয়ে যাওয়ার পরেও রাজধানীবাসীর অনেকে এসেছেন প্রথমবারের মতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী বিপ্লব মল্লিক বলেন, গবেষণা আর অভিসন্দর্ভের ব্যস্ততায় মেলার সতেরতম দিনেই আসতে পেরেছেন তিনি। সমাজ সচেতনতা আর রাজনীতি বিষয়ক বইয়ের দিকে ঝোঁক এই তরুণের। তুহিন ও সজল এসে খুঁজলেন জীবনের গল্প।

গৃহিণী মুক্তা আনোয়ার পছন্দ করেন কবিতা। তিনি খুঁজে বেড়ালেন তরুণ কবিদের কবিতাসমগ্র। তিন তরুণ রাসেল, হাসান ও সিয়াম কিনে নিলেন তরুণ লেখক ওবায়েদ হক ও সাদাত হোসাইনের নতুন গল্পসংকলন। অনুবাদের খুঁজে এসে সংগীতা ঘোষ কিনেছেন হুমায়ূন আজাদের একাধিক বই।

প্রতিদনের মতো সেবা প্রকাশনীর সামনে ছিল তরুণ পাঠকদের ভিড়। অনুবাদের বইয়ের পাশাপাশি এদিন দারুণ বিক্রি হয়েছে তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানা সিরিজ। মণিপুর স্কুলের ছাত্র সিয়াম, ইমন ও সেতু, ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তরুণ কর্মকর্তা নোবেল-সবাই মেলায় এসে শুরুতেই সংগ্রহ করেছেন সেবা প্রকাশনীর বই।

রাজ বলেন, “ছোটবেলায় সিলেবাসের বাইরে প্রথম যে বইটি পড়েছিলাম তা সেবার। সেবার বইয়ের প্রতি অন্যরকম এক ঝোঁক বরাবরই কাজ করে। তাই প্রথমেই ছুটে এসেছি এখানে।”

শুক্রবার মেলায় এসে কথা হল লেখক-ঔপন্যাসিক আনোয়ারা আজাদের সঙ্গে। জয়তী প্রকাশন থেকে এবার এসেছে তার ‘বিহারী বৃত্তান্ত’ উপন্যাসটি।

তিনি বলেন, “এবার ছেলেমেয়েরা দেখছি উপন্যাসই বেশি কিনছে। তাছাড়া ফেইসবুকে প্রকাশিত বই নিয়ে নানা আলোচনায় মেতে উঠছে তারা। বইয়ের ইতিহাস, লেখক পরিচিতি নিয়েও তারা মেলায় এসে খোঁজ নিচ্ছে। তরুণ পাঠকের এই আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করছে।”

অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার মীর আলী আখতারের গবেষণাধর্মী বই ‘ভাওয়াইয়া’ এসেছে এবারের বইমেলায়।

তিনি বলেন, “সঠিক জ্ঞান আহরণের জন্য ছেলেমেয়েরা কিন্তু তাদের পছন্দসই বই ঠিকই খুঁজে নেবে। সবচেয়ে বড় কথা, ওরা বাংলা ভালো করে শিখুক। আজকাল যা হচ্ছে, বাংলার তো অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে ওরা।”

তখন সন্ধ্যা নামছে, ভিড় ক্রমশ বাড়ছে বইমেলায়। এর আগে অমর একুশে উদযাপন উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৯টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্ব। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।

এছাড়া শুক্রবার ফল ঘোষণা করা হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার।

ক-শাখায় অনুভা হালদার, মিনহাজ জামান শান এবং মানহা মারনিয়া জামান। খ-শাখায় তাসনিম সুলতান মহীয়সী, ফারহাত লামিসা, অতন্দ্রীলা পদ্য দে। গ-শাখায় আর্ণিকা তাহসীন, নাহিয়ান মাইশা অয়মী এবং কানিজ ফাতেমা।

নতুন বই

মেলার সতেরতম দিনে ২৪১টি নতুন বই মেলায় এসেছে এবং ৬৪টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে পাঞ্জেরী থেকে ইমদাদুল হক মিলনের শিশুতোষ গ্রন্থ ‘হাতি গিয়েছিলো মানুষ দেখতে, বিজ্ঞান একাডেমি থেকে আলী ইমামের ‘বুক অব নলেজ পাস, ন্যাশনাল পাবলিকেশন্স থেকে ড. আনু মাহমুদের ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’।

এছাড়া কথাপ্রকাশ এনেছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘মা মেয়ের উপাখ্যান, আগামী এনেছে বদিউল আলম মজুমদারের ‘রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে করণীয়’, নালন্দা এনেছে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর ‘খুশবন্ত সিংয়ের জোকস’।

মূলমঞ্চের আয়োজন

বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আশির দশকের কবিতা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি কুমার চক্রবর্তী। আলোচনায় অংশ নেন ড. মাসুদুল হক এবং ড. আমিনুর রহমান সুলতান। সভাপতিত্ব করেন কবি রুবী রহমান।

কুমার চক্রবর্তী বলেন, “বাংলাদেশের পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের কবিতায় পশ্চিমি আধুনিকবাদ, পরাবাস্তববাদ ও ক্ষেত্রবিশেষে অস্তিত্ববাদী সঙ্করায়ণ ও অতিচর্চার যে অনুকরণসর্বস্ব প্রচেষ্টা ছিল, আশির দশক এসব পেন্ডোরাবাক্স থেকে বেরিয়ে এসে কবিতার নতুন পরিচয়সন্ধানে রত হয়েছিল। সম্ভবত এ অন্বেষণটি এখনও স্বতশ্চল আমাদের কবিতার বদ্বীপে, কেননা এই ধারণাটি প্রজন্মান্তরে এখনও চর্চিত। ”

সভাপতির বক্তব্যে কবি রুবী রহমান বলেন, “আমাদের ভাবনার জগতে রাজনীতির যে বিস্তার রয়েছে, তার ছায়াপাত ঘটেছে আশির দশকের কবিতাতেও। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক পটভূমি তার সাথে আশির দশকের কবিতা বিজড়িত। আশির দশকের কবিদের তৈরি পথ দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা বাংলা কবিতার ধারাকে এতোদূর নিয়ে এসেছে।”