রাষ্ট্রনীতি ও ধর্ম বিশ্বাসের বিরোধ নেই: মসিউর

সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেওয়ার জোরালো দাবি থাকলেও সামরিক শাসনামলে সংবিধানে যোগ হওয়া ওই বিধানের পক্ষেই যুক্তি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2017, 10:08 AM
Updated : 17 Feb 2017, 10:08 AM

শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলছেন, রাষ্ট্রনীতি ও ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ নেই, রাষ্ট্র ‘আলাদা ক্যাটাগরির জিনিস’।

ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শুক্রবার ঢাকাস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতির ‘সপ্তম চাঁপাই উৎসবের’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর।

এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে পতাকা উত্তোলনের সময় দেখা একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “পতাকা তোলার সময় সময় আমি লক্ষ্য করছিলাম, একজন একটু বয়স্ক লোক, ধর্ম বিশ্বাসী একজন বয়স্ক লোকের যে আচরণ, দাড়ি আছে পাঞ্জাবি পড়েছেন। আরেকজন ভদ্রলোক, অতটা বয়স দেখা যায় না, মাখায় টুপি, বোধহয় নামাজ পড়তে যাবেন বলে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় দেখলাম তারা দুইজনই সুর মেলাচ্ছেন।

“আমার একটু কৌতুহল হল। সুর মেলাচ্ছেন, আবার মাথায় টুপি আছে, দাড়ি আছে। আমরা তো সাধারণভাবে মনে করি ধর্ম এবং ধর্ম সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা একসাথে থাকতে পারে না।”

মসিউর বলেন, “এই দৃশ্যপট বলছি এজন্য যে … আমাদের সংবিধানে যে অসম্প্রদায়িকতার কথা আছে, এটাকে অনেকে মিথ্যা বা অনেকে ভুল ব্যাখ্যা করেন। এটা ধর্মহীনতা নয়, এটা ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা।

“আমার ধর্ম আমি পালন করছি, রাষ্ট্র আলাদা অন্য ক্যাটাগরির একটা জিনিস। রাষ্ট্রের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে, রাষ্ট্রকেও আমি ভালবাসি, রাষ্ট্রকে আমি রক্ষা করব। কিন্তু রাষ্ট্রনীতি এবং আমার ধর্ম বিশ্বাস এই দুটোর ভেতরে কোনো দ্বন্দ্ব নাই, কোনো সংঘর্ষ নাই।”

সব ধর্মের মানুষের সম্মিলিত সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত‌্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টোযাত্রায় ক্ষমতা নিয়ে জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে সেখানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা’র কথা বসান।

এরপর আরেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ অষ্টম সংশোধনী এনে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যোগ করেন।

নিজের জীবনাচরণে ইসলামের কোনো প্রতিফলন না থাকলেও শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন‌্য এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।

এরশাদ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রধর্মের বিধান বাদ দেওয়ার দাবি বিভিন্ন সময়ে উঠলেও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগও তাতে হাত দেয়নি।

২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীতে দলটি ১৯৭২ এর চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ আগের মতোই থেকে যায়।

পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধান পুরোপুরি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন মহলের দাবি রয়েছে।

মসিউর বলেন, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতার ‘মূল লক্ষ্য’ হল ধর্মীয় সহিষ্ণুতা।

পতাকা তোলার সময় দেখা ওই ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই দুজন লোককে দেখে আমার মনে হল যে, আমরা হয়ত মঞ্চে এক রকম কথা বলি বা দলের সাথে সম্পৃক্ত করে কথা বলি। কিন্তু বাংলাদেশের একজন মানুষ, যে দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়, সরকারের সাথে সম্পৃক্ত নয়, সে তার নিজের জীবন-জীবিকা অর্জন করছেন, তার মনে কী আছে?

“আমার মনে হল, তার মনে যে কথা আর বঙ্গবন্ধু যেটা বলেছেন সেটা এক। আমাদের সংবিধানের যে নীতি- অসম্প্রদায়িকতা, এটা হল ধর্ম সহিষ্ণুতার, অপরের প্রতি সহিষ্ণুতার এবং সকলের ধর্ম পালনের অধিকারের। তার সঙ্গে তার নাগরিকত্বের অধিকার, নাগরিকত্বের দায়িত্ববোধের সংঘর্ষ নাই।”

মসিউর বলেন, এ বিষয়টি সবাইকে বুঝতে হবে এবং প্রচার করতে হবে। যারা এর বিরুদ্ধে গিয়ে নাশকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, তারা আসলে ধর্মের জন্য নাশকতা করছেন না। তারা ‘অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে’ নাশকতা করেন, ধর্মকে ‘মিথ্যাভাবে ব্যবহার করেন’।

“আসলে ওরাই ধর্মবিরোধী, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে একসাথে দাঁড়াতে হবে।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জে সরকারি চাকরি করার সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনার স্মৃতি অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন মসিউর। আয়োজকদের দাবিরে পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় আন্তঃনগর ট্রেন চালুর বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।

এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের সম্ভাবনা নিয়ে কৃষিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রীর এ উপদেষ্টা।

ঢাকাস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতির সভাপতি মো. নুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে অন‌্যদের মধ‌্যে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান, ঢাকাস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক উজির আলী বক্তব্য দেন।

দিনব্যাপী এই উৎসবে বেশ কয়েকটি স্টলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সামগ্রী প্রদর্শনের পাশাপাশি সেগুলো বিক্রিও করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।