শতবর্ষী ‘পাই’ থেকে হালের রেডিও ভাণ্ডার

১০০ বছরের পুরনো ‘পাই’ ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে আছে সর্বশেষ ন্যাশনাল, ফিলিপসসহ নানা ব্র্যান্ড; বাক্সের আকার থেকে হাল আমলের ইঞ্চি অবয়ব, আছে চন্দ্রাকৃতিসহ বিচিত্র ডিজাইন- প্রযুক্তি এগিয়ে চলার সাক্ষী এ রকম পাঁচশ রেডিওর ভাণ্ডার তৈরি করেছেন আগারগাঁওয়ের মোফাজ্জল হোসেন।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2017, 05:15 PM
Updated : 13 Feb 2017, 08:39 AM

এক সময় বিনোদন বা খবরের একমাত্র এই সম্প্রচার মাধ্যম সংগ্রহের কাজ মোফাজ্জল শৈশবের আগ্রহ থেকে শুরু করলেও সময়ের ব্যবধানে এখন সেটা বড় আকার লাভ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ‘রেডিও’ সংগ্রহের ইচ্ছা থেকে কাজ করতে গিয়ে যেখানে পেয়েছেন সেখান থেকেই পুরনো রেডিও সংগ্রহ করেছেন তিনি।

দোকান বা বাসাবাড়িতে গোল হয়ে বসে একসঙ্গে রেডিও শোনার স্মৃতি যখন অতীত, তখন প্রতিবছর ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবসে আগারগাঁওয়ের বেতার ভবনে এসব রেডিওর প্রদর্শনী করেন মোফাজ্জল; এবারের প্রদর্শনীর প্রস্তুতির মধ্যে রোববার সকালে কথা হয় তার সঙ্গে।

মোফাজ্জল জানান, মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৮৫ সালে রেডিও সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। এখন তার সংগ্রহে আছে বিচিত্র রকমের প্রায় পাঁচ শতাধিক রেডিও।

তিনি বলেন, “আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা ছিলেন রেডিও মেকার। ময়মনসিংহে তার দোকানে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন ও যুদ্ধদিনের গল্প করতেন। তাদের গল্পের মধ‌্যে রেডিও শুনে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের কথাও বারবার আসত।”

সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধকালে ব্যবহৃত রেডিও সংগ্রহের চিন্তা মাথায় চাপে বলে জানান মোফাজ্জল।

“বাবাকে বলতাম, রেডিওর এতো অবদান, এতো স্মৃতি, রেডিও-ওতো যুদ্ধ করেছে- এগুলো কি সংগ্রহ করা যায় না?”

১৯৭৩ সালে জন্ম নেওয়া মোফাজ্জল জানান, বাবার কিছুটা সায় পেয়ে কাজ শুরু করে এক পর্যায়ে রেডিও সংগ্রহের জন্যই ঢাকার পথ ধরেন তিনি। তখন থেকে পুরনো ‘এনটিক’ ঘড়ি সারিয়ে বিক্রি করার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি চলে রেডিও সংগ্রহের কাজ।

“মানুষ বলতো, ময়মনসিংহে থেকে কী হবে? ঢাকায় যাও, সেখানে গেলে অনেক রেডিও পাবা। আমিও ঢাকায় চলে আসি।”

মোফাজ্জলের সংগ্রহের রেডিওর মধ্যে আছে ১০০ বছরের পুরনো জার্মানির ‘পাই’ ব্র্যান্ডের রেডিওগ্রাম, বড় বাক্স আকৃতির এই যন্ত্রে রেডিওর পাশাপাশি গ্রামোফোন বাজানোর ব্যবস্থাও ছিল।

২০০০ সালে টিউব পোর্টেবল প্রযুক্তির এ রেডিওগ্রামটি মোফাজ্জল কেনেন গাজীপুরের এক ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি একটি জমিদার বাড়ি থেকে সেটি  সংগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন তাকে।

এত পুরনো হলেও রেডিওগ্রামটি এখনও সচল আছে বলে জানান মোফাজ্জল।

স্ট্যান্ড সংযুক্ত গোলাকৃতির থ্রি-ইন-ওয়ান একটি রেডিও তিনি সংগ্রহ করেন ধানমন্ডির এক ব্যক্তির কাছ থেকে। ফেরিওয়ালার মাধ্যমে খবর পেয়ে সেখান থেকে ২০০০ সালে ৩০ বছর আগের তৈরি রেডিওটি কেনেন মোফাজ্জল।

তিনি বলেন, “স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে ২৭ হাজার টাকা দিয়ে ওয়েলট্রন ব্র্যান্ডের রেডিওটি কিনেছিলাম।”

এতে রেডিওর সঙ্গে গ্রামোফোন ও ক্যাসেট প্লেয়ারও ছিল বলে জানান তিনি।

বাবার দোকানে দেখে দেখে রেডিওর প্রতি আগ্রহী হওয়ার কথা জানানোর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে তার বাবা আবদুল ফারুকের ব্যবহৃত দুটি রেডিও সযত্নে আগলে রাখার কথাও বলেন মোফাজ্জল।

“বাবা যুদ্ধের ময়দানে যে রেডিও ব‌্যবহার করেছিলেন, সেটা তিনি যত্ন সহকারে রেখেছিলেন। আমিও আমার সংগ্রহে সেটা রাখছি।”

ফিলিপস ও সিটিজেন ব্র্যান্ডের সেই রেডিও দুটি এখনও সময় পেলে বাজিয়ে দেখেন বলে জানান সংগ্রাহক মোফাজ্জল।

১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্স-প‌্যাসিফিক জেনিথের তৈরি একটি রেডিও গুলশানের একটি পুরাতন জিনিসপত্রের দোকান থেকে কেনেন তিনি। ’৯৮ সাল থেকে বড় আকারের এই সম্প্রচার যন্ত্র তার সংগ্রহে রয়েছে।

এছাড়া ১৯৪০ সালের দিকে তৈরি মারফি, ১৯৪৭ সালে হল‌্যান্ডে তৈরি ফিলিপসের রেডিওসহ সনি, এক্সবিএস, সনিয়া, সার্প, গোল্ডস্টার ব্র্যান্ডের নানা ধরনের রেডিও সংগ্রহ করেছেন তিনি।

মোফাজ্জলের সংগ্রহে আছে কোকা-কোলার বোতল, এটিএম কার্ড সদৃশ রেডিও। ঘড়ি সৃদশ এক ইঞ্চি মাপের কিংবা প্রাইভেটকার ডিজাইনের রেডিও যন্ত্রও তার সংগ্রহে আছে।

সিলেট থেকে কেনা ন‌্যাশনাল-প‌্যানাসনিক ব্র্যান্ডের পুরাতন একটি রেডিও দেখান মোফাজ্জল, যেটাকে ঘুরিয়ে চাঁদের মতো আকৃতি দেওয়া যায়। আবার আরেকবার ঘুরিয়ে করা যায় টেলিফোন রিসিভারের মতো।

পুরাতন রেডিও কিনতে গিয়ে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা পেরোনো এবং মজার ঘটনারও বর্ণনা দেন ‍তিনি।

১৯৮৮ সালের দিকে সিলেটে একটি রেডিও সংগ্রহ করতে গিয়ে ক্বিন ব্রিজে রিকশা ঠেলে টাকা আয়ের ঘটনায়ও কথায় কথায় তুলে ধরেন মোফাজ্জল।

তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ীতে এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে আলাপে সিলেটে এক দর্জি দোকানির কাছে একটি রেডিও আছে বলে জানতে পারেন।

“বয়সে ছোট, আমার সংগ্রহের শুরুও হয়েছে মাত্র ২-৩ বছর। গেলাম সিলেটে। কিন্তু ওই লোক রেডিও’র দাম চাইছিল ২ হাজার টাকা। আমার কাছে অতো টাকা নাই, পড়ে গেলাম বিপদে।

“আমার বলতে দ্বিধা নাই… কী করা যায়, কী করা যায় ভাবতে ভাবতে সুরমা নদীর উপর উঁচু ব্রিজে রিকশা ঠেলার কাজ নিলাম। সেখানে ঠেলে রিকশা উঠায় দিলে প্রতি রিকশায় দুই টাকা করে পওয়া যেত। এভাবে টাকা জমিয়ে ১৯৫০ সালে জার্মানিতে তৈরি টেলিফানকেন ব্র্যান্ডের রেডিওটি কিনছি।”

পুরান ঢাকার জিনজিরায় পুরান রেডিও কিনতে গিয়ে দোকানিকে পায়ের নতুন জুতা দিয়ে খালি পায়ে আগারগাঁওয়ের বাসায় ফেরার কথাও বলেন মোফাজ্জল।

সংগ্রহের এই পর্যায়ে এসে তার ইচ্ছা রেডিও জাদুঘর করার। রেডিও তরঙ্গ সূত্রের আবিষ্কারক হিসাবে স‌্যার জগদীশচন্দ্র বসুর নামেই সেটা করতে সরকারি উদ‌্যোগের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

নিজে একটি রুম ভাড়া নিয়ে কোনো রকমে রেডিওগুলো সংরক্ষণের কথা জানিয়ে মোফাজ্জল বলেন, “ব‌্যক্তিগতভাবে অনেক দেশে রেডিও সংগ্রাহক আছেন, কিন্তু কোথাও রেডিও জাদুঘর আছে বলে আমার জানা নাই। এ কারণে আমাদের একজন বাঙালি যেভাবে প্রথম রেডিওর সূত্র আবিষ্কার করেছেন, সেভাবে আমরাও জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় প্রথম হতে চাই।”

এর মাধ‌্যমে রেডিও’র যে অবদান ছিল এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিকাশের আগে এটার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মানুষ সহজে জানতে পারবে বলে মন্তব‌্য করেন তিনি।

মোফাজ্জলের রেডিও প্রদর্শনীস্থলে এসে রেডিও ‘শুনে শুনে’ বড় হওয়ার স্মৃতিচারণ করেন বাংলাদেশ বেতারের সিনিয়র সঙ্গীত পরিচালক আতিকুর রহমান।

ফিলিপসের একটি রেডিও দেখিয়ে তিনি বলেন, “আগে একটা অন‌্য ব্র্যান্ডের ছিল। সাউন্ড ভালো হওয়ায় পরে এটা কিনেছিলাম।”

সত্তরোর্ধ্ব এই সঙ্গীত পরিচালক বলেন, “আমরা তো রেডিও শুনে বড় হয়েছি। তবে প্রযুক্তির বিবর্তনে টেলিভিশন থেকে শুরু করে এখন ইন্টারনেটের বিস্তার ঘটেছে। রেডিও যন্ত্রের প্রতি আবেদন নেই। তবে মোবাইলেতো এখনো রেডিও শোনা যাচ্ছে।”