এখন বাবুল আক্তারকেই সন্দেহ শ্বশুরের

মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডে তার স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তারকেও এখন সন্দেহ করছেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবনিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2017, 02:27 PM
Updated : 8 Feb 2017, 02:37 PM

বাবুলের সাম্প্রতিক কিছু আচরণ এবং তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য আসায় এই সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি; যদিও হত‌্যাকাণ্ডের পর নানা গুঞ্জনের মধ‌্যেও জামাতার পক্ষেই বলছিলেন তিনি। 

বাবুলের মায়ের পরিবারে খুনের ইতিহাস আছে দাবি করে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন যেসব শুনছি তার কিছুটাও যদি সত্য হয় তাহলে তো বুঝব, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাবুল আমার বাসায় থেকে অভিনয় করেছে।

“আসলে তখন তো আপনারা তাকে প্রশ্ন করতে পারেন নাই। আমিই আপনাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। আসলে ভুলটা আমারই হয়েছে। এটা তার এক ধরনের কৌশল ছিল।”

গত বছর ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামে শহরে প্রকাশ্যে খুন হন বাবুলের স্ত্রী মিতু। তার কিছুদিন আগে এসপি পদে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রামের গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্ব ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন বাবুল।

প্রথমে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্তের কথা জানায় পুলিশ।

কয়েক সপ্তাহ পর এক রাতে ঢাকার বনশ্রীর শ্বশুর বাড়ি থেকে তুলে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে এনে বাবুলকে ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর নানা গুঞ্জন ছড়াতে থাকে।

তখন পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা না হলেও কয়েক মাস পর বাবুলের পদত্যাগপত্র গ্রহণের কথা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। 

গত ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন মিতুর বাবা মোশাররফ ও মা সাহেদা মোশাররফ নীলা।

ওই সময় দুই সন্তান নিয়ে শ্বশুর বাড়িতেই ছিলেন বাবুল। তখন সাংবাদিকরা গেলে তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেনই কথা বলতেন, বাবুলের পক্ষেই ছিল তাদের অবস্থান।

মেয়ের মৃত্যুর জন্য এখন জামাতা সন্দেহে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের মতামত ছাড়াই বাবুল আমার নাতিদের নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। কোনো ধরনের যোগাযোগ করে না। আদ-দ্বীন হাসপাতালের মালিক বাবুলকে চাকরি দিয়েছে। সেও বলেছিল, বাবুল যেন অন্তত দুই বছর এখানে থাকে। সে চাকরি পেয়ে ওই কথাও শোনে নাই।

“এখন যেহেতু বাবুল চলে গেছে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডাকার পর চট্টগ্রামে যাই। মামলার বাদী হয়েও বাবুল সেখানে যায়নি। অথচ বাদীর দায়িত্ব সাক্ষীকে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সেখানে বলেছি, মাহমুদাকে হত্যার মোটিভটা আমরা জানতে চাই।”

গত ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন মিতুর বাবা মোশাররফ ও মা সাহেদা মোশাররফ নীলা।

“মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাবুল কেন চাকরি ছেড়ে দিল? আপনারা কী মনে করছেন। ওই তদন্ত কর্মকর্তা বলেছে, আপনি তাকেই প্রশ্ন করুন। তিনি খুব ভালোভাবে জানেন কেন বাবুল চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন,” বলেন মোশাররফ।

তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার পর বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন মিতুর বাবা-মা।

সে প্রসঙ্গ তুলে মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক নারী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম, বাবুল ও মাহমুদা দুজনেরই পরকীয়া থাকতে পারে। তোমাদেরও থাকতে পারে। বাবুল আক্তারের সঙ্গে কারও প্রেম হলো, সে তো নিশ্চয়ই চাইবে না বাবুল আক্তারের বউ থাকুক। সেও তো কোনো ক্ষতি করে থাকতে পারে। তদন্ত কর্মকর্তাকে বারবার খুনের মোটিভটা খুঁজে বের করতে অনুরোধ করেছি।”

বনানী বিনতে বসির বর্ণি নামের যে নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে তার স্বামী পুলিশের এসআই আকরাম হোসেন লিটনের মৃত্যুর তদন্তও চেয়েছেন মোশাররফ।

তিনি বলেন, “কয়েকদিন আগে বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে একটি পত্রিকায় পরকীয়ার একটি সংবাদ হয়েছিল। ২০১৫ সালে ওই এসআই মারা যান। তার বোন জান্নাত আরা রীনি তার পরিবারসহ আমার বাড্ডার বাসায় এসেছিল। তখন তারা বাবুলের সঙ্গে তার ভাইয়ের স্ত্রী বনানী বিনতে বসির বর্ণির ‘পরকীয়ার’ পুরো ঘটনাটিই আমাকে বলেছে।

বাবুলের সঙ্গে স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু

“এখন যা শুনছি, এমন অভিযোগ বাবুলের বিরুদ্ধে আজীবন ছিল। শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা মাহমুদাকে অত্যাচার করত। ঘটনার ১৫ দিন আগেও বাবুল আক্তারের বাসায় একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল।”

“এখন তো ঢাকায়, নোয়াখালী, বিদেশেও তার পরকীয়ার কথা শুনি। আগে এই সব শুনেও তাকাইনি। মিতুও কোনো অভিযোগ করত না।”

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ‘সড়ক দুর্ঘটনায়’ আহত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তা আকরাম।

বাবুলের পাশের জেলা ঝিনাইদহের ছেলে আকরামকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে বলে তার পরিবার অভিযোগ করে। তবে সে সময় পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের হস্তক্ষেপে ওই ঘটনার তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ আকরামের বোনের। বাবুলের বাবাও একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক।

আকরামের স্ত্রী বর্ণির সঙ্গে বাবুলের সম্পর্কের জেরেই তার ভাই খুন হয়েছেন বলে দাবি জান্নাত আরা রীনির।

এখন বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেনও তার মৃত্যুর তদন্ত চাইছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা (আকরামের স্বজন) সব বলেছে, আমরা বলেছি তোমাদের ঘটনার তদন্ত হোক। আমাদেরটাও হোক। দুটো ঘটনাতো মিলেও যেতে পারে। এটা তো বলা যাচ্ছে না। অনেক ঘটনাই তো বেরিয়ে আসছে।”

এতদিন পরে বাবুলের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ কেন আসছে তারও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন মোশাররফ।

“আমি তো বাবুলের বিষয়ে সব সময় আগে পজিটিভ বলেছি। তাই আগে তারা কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।”

জান্নাত আরা রীনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার ভাই আকরাম ২০০১ সালে পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদে যোগ দেন। পরের বছর তার একটি মেয়ে হয়। তখন বাবুল আক্তারের এক আইনজীবী ভাই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বোন তাদের দেখতে আসেন।

“তাদের আচরণে সন্দেহ হলে ভাই লিটনকে জানাই। লিটন বলেছিল, বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার স্ত্রী বর্ণির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এজন্য দুই পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সুসম্পর্ক আছে। ওই দিনই বাবুল আক্তারের সঙ্গে বর্ণির সম্পর্কের বিষয়টি প্রথম জানতে পারি।”

এসআই আকরাম হোসেন লিটন, তার স্ত্রীর সঙ্গে বাবুলের সম্পর্কের অভিযোগ তুলেছেন স্বজনরা

বিয়ের কয়েক বছর পর আকরাম এক বছরের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান। সেখান থেকে স্ত্রীকে বারবার ফোন করলেও মোবাইল ফোন ব্যস্ত পাওয়ার কথা ভাই জানিয়েছিলেন বলে দাবি করেন রীনি।

তিনি বলেন, দেশে ফেরার পর আকরাম মগবাজারে একটি ফ্ল্যাট কেনে।

“এরই মধ্যে বাবুল আক্তারকে নিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। ২০১৪ সালে নভেম্বরে বর্ণি তার বাবার বাড়ি ঝিনাইদহে যায়। এক মাস পর আকরামকে মোটর সাইকেলে করে যমুনা সেতু হয়ে এসে বাড়ি নিয়ে যেতে বলে।”

“২৮ ডিসেম্বর রাতে জানতে পারি, আকরাম সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় শৈলকূপা থানার বরদাহ মাঠ থেকে উদ্ধার করে ফরিদপুরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়।”

ওই সময় আকরামের মোটর সাইকেলের শুধু হেডলাইটটি ভাঙা ছিল দাবি করে জান্নাত আরা রীনি বলেন, “ভাইয়ের সারা শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। মাথায় ছিল ধারালো অস্ত্রের কোপের চিহ্ন।”

এরপর ১৩ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আকরামের মৃত্যু হয়।

তার ভাইকে বর্ণি ‘বাবুল আক্তারের পরামর্শে পরকীয়ার জের ধরে’ হাসপাতালের দেওয়া খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করে বলে আকরামের বোন ও স্বজনদের সন্দেহ।

আকরামের যেন ময়নাতদন্ত করা না হয় সেজন্য বর্ণি শাহবাগ থানায় আবেদন করেছিলেন বলেও জানান তিনি।

এরপর ১৯ জানুয়ারি বর্ণি, তার বাবা বসিরউদ্দিন বাদশা, মা সেলিনা আক্তার ও তার এক খালাতো ভাই খাদেমুল হক মুনের নাম উল্লেখ করে ঝিনাইদহের শৈলকূপা থানায় একটি হত্যা মামলা করে আকরামের পরিবার।

রীনি বলেন, “বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার কথা জানানো হলেও পুলিশ তার নাম এজাহারে লেখে নাই।

আকরামের স্ত্রী বনানী বিনতে বসির বর্ণি মঙ্গলবার মাগুরা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বাবুলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন

“পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বারবার বলেছিল, বাবুল আক্তার নামের এক ‘পুলিশ স্যার’ আপনাদের মামলাটাকে এগিয়ে নিতে দিচ্ছে না। আপনার ভাইয়ের হত্যার কোনো বিচার হবে না।”

তিনি বলেন, “ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে বর্ণি বাবুল আক্তারের মাগুরার বাসায় স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকত। পরিবারের সদস্যরা সব জানলেও তারা কিছু বলে না।”

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বাবুল আক্তারকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

তবে বিষয়টি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশের পর ফেইসবুকে তিনি লিখেছেন, এসআই আকরাম যখন মারা যান তখন দক্ষিণ সুদানে মিশনে ছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় তার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্ট নেই।

যে নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই বর্ণি মঙ্গলবার মাগুরা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, বাবুল আক্তারের সঙ্গে কখনোই তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করা এবং ঢাকার মগবাজারে তার মেয়ের নামে কেনা স্বামীর ফ্ল্যাট দখল করতেই ননদরা এই মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

বর্ণির বাবা বসির উদ্দিন বাদশা বুধবার বিডিনিউজ টোয়েনিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১২ সালের দিকে ঝিনাইদহের সোনারগাঁও হোটেলে বাবুল আক্তারের বাবা আব্দুল ওয়াদুদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর ওই রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা করার কারণে তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা বাড়ে।

“তখনও তার পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যখন আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করল, তখন আব্দুল ওয়াদুদ সাহেবের সহায়তায় মাগুরা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম।”

বাবুলকে জড়িয়ে তার মেয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগকে ষড়যন্ত্র দাবি করে তিনি বলেন, “বর্ণির স্বামীর রেখে যাওয়া ফ্ল্যাট থেকে সে মাসে ১৪ হাজার টাকা পায়। সম্পত্তি হাতিয়ে নিতেই শ্বশুর বাড়ির লোকজন তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে।”