এক মোড়কে মুহিতের ষাট বছর

অশীতিপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ঘটনাবহুল কর্মজীবনের স্মৃতিকথা প্রকাশ হচ্ছে বুধবার।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2017, 03:14 PM
Updated : 24 Jan 2017, 03:20 PM

‘স্মৃতিময় কর্মজীবন’ নামে ১৭৬ পৃষ্ঠার এই বইয়ে মুহিতের ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন উঠে এলেও ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কর্মজীবনের ঘটনাবলী বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে লেখক জানিয়েছেন।

একুশের বইমেলা সামনে রেখে বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। সাবেক আমলা মুহিতের কর্মজীবন নিয়ে বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তার ‘কাছের লোকেরা’ উপস্থিত থাকবেন।

১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া মুহিত বুধবার ৮৩ বছর পূর্ণ করবেন। জন্মদিন উপলক্ষেই বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

তার জীবনের প্রথম পর্ব ১৯৩৪ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলী নিয়ে ‘সোনালী দিনগুলি’ প্রকাশিত হয় গতবছর বইমেলায়। ওই বইয়ের ধারাবাহিকতায় ‘স্মৃতিময় কর্মজীবন’ লিখেছেন মুহিত।

বইটির বিষয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোনালী দিনগুলিতে লিখেছিলাম, আমি আমাকে নিয়ে আরও দুটি বই বের করব। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১ এবং ১৯৭১ থেকে পরবর্তী সময় নিয়ে বের হবে সে দুটি বই।

“সেই দুটি বইয়ের একটি ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১ আমার ‘স্মৃতিময় কর্মজীবন’ বুধবার প্রকাশিত হচ্ছে। পরের বইটিও যথাসময়ে প্রকাশিত হবে।”

দশটি অধ্যায়ে সাজানো হয়েছে ‘স্মৃতিময় কর্মজীবন’, যেখানে মুহিতের ষাট বছরের কর্মজীবনের ইতিহাস উঠে এসেছে।

প্রথম অধ্যায়ই-ষাট বছরের কর্মজীবন, দ্বিতীয় অধ্যায়- স্বদেশে ’৫৮ সালে গণতন্ত্র ধ্বংসের সূত্রপাত, তৃতীয় অধ্যায়- বাগেরহাটে এক বছর, চতুর্থ অধ্যায়- মাহামান্য ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উৎসব উদযাপন।

পঞ্চম অধ্যায়- পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের সাংবিধানিক একনায়কত্ব এবং আমেরিকায় আমার প্রথম ভ্রমণ, ষষ্ঠ অধ্যায়-দেশে ফিরে পশ্চিম পাকিস্তানে পদায়ন, সপ্তম অধ্যায়- পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ বছরের প্রথম পর্ব ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮, অষ্টম অধ্যায়- পশ্চিম পাকিস্তানে আমার শেষ কটি আলোড়নমুখর মাস ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯, নবম অধ্যায়- যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসে পদায়ন এবং দশম অধ্যায়- একাত্তরের দিনপঞ্জি।

ষাট বছরের কর্মজীবনে মুহিত লিখেছেন, “আমি আমার স্মৃতিকথার প্রথম খণ্ড শেষ করেছি, আমার জীবনের প্রথম বাইশটি বছরের কথা বিবৃত করে। ১৯৫৫ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত আমি শিক্ষাজীবনের শেষ পরীক্ষা এমএ দিই। অতঃপর চাকরি পাবার জন্য কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিই ১৪ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তারপর ১৯৫৬ সালের ১৬ জানুয়ারি এক ধরনের কর্মজীবন শুরু করি। তবে অপেক্ষায় থাকি কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান অর্থাৎ সিএসপি ক্যাডারে যোগ দেবার আকাঙ্ক্ষায়। ১৯৫৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আমি সেই সার্ভিসে যোগ দেবার জন্য সলিমুল্লাহ হল ত্যাগ করি এবং ১২ সেপ্টেম্বর লাহোরে সিভিল সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে যোগ দিই।

“এই অ্যাকাডেমি ছিল একটি পুরোনো প্রাসাদ, নাম রেসিডেন্সি বিল্ডিং। এই স্থাপনায় আমাদের মোট একুশ জনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা যেমন ছিল, খেলাধুলার জন্য টেনিস কোর্ট, অন্যান্য মাঠ এবং ঘোড়ায় চড়ার জন্য একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রও ছিল।

ওই স্থাপনার দুই অংশে ছিল অ্যাকাডেমির পরিচালক ও তার ডেপুটির জন্য দুটি উন্নতমানের বাড়ি। সেখানে উন্নতমানের খাবার এলাকা অথবা বাগানে পার্টি করারও ভালো সুযোগ ছিল। পরিচালক ও সহকারী পরিচালক অ্যাকাডেমিতে সপরিবারে অবস্থান করতেন।

“আমাদের সময় অ্যাকাডেমির পরিচালক ছিলেন প্রাক্তন আইসিএস কর্মকর্তা জিওফ্রে বার্জেস এবং তার ডেপুটি ছিলেন প্রথমে পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক সার্ভিসের সদস্য আবুল মাসুদ সায়িদ এবং কিছুদিন পরে সায়িদ সাহেবের বদলি হলে তার জায়গায় ফয়েজুদ্দিন আহমাদ।”

বইয়ের শেষ দশম অধ্যায়ে একাত্তরের দিনপঞ্জিতে অর্থমন্ত্রী মুহিত লিখেছেন, “আমার স্মৃতিকথার প্রথম খণ্ড আমার জীবনের প্রথম বাইশ বছরে এসে শেষ হয়। ঐ খণ্ডের সমাপ্তি টানাটা ছিল খুবই সহজ। জন্ম থেকে ছাত্রজীবনের সমাপ্তি পর্যন্ত সময়ের কাহিনী খণ্ডটিতে প্রকাশিত হয়।

“এবারে দ্বিতীয় খণ্ডের সমাপ্তি টানতে কিন্তু অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে এবং কোথায় সমাপ্তির সময় রেখা টানব, তা স্থির করতে অনেকটা ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করতে হয়েছে।”

কর্মজীবনের ষাট বছর পূর্ণ হওয়ার কথা জানিয়ে মুহিত লিখেছেন, “এখানে বিভিন্ন খণ্ডের কাহিনী কোনো একটি ছক বেঁধে বিবৃত করা কষ্টকর মনে হচ্ছে। তবে লিখতে গিয়ে দেখি, দ্বিতীয় খণ্ডের সমাপ্তির সময়টি যেন স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই খণ্ডের সমাপ্তিরেখা হবে ১৯৭১ সাল।

“ওই বছরে আমাদের জাতি এবং রাষ্ট্রগত পরিচয় এক নতুন রূপ লাভ করে। বাংলাদেশে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করি এবং তার পরিচালনার দায়িত্ব আমরা নিজেরা গ্রহণ করি। এর আগে যত শাসক এদেশে ছিল তারা সবাই ছিল বহিরাগত। অবশ্য শুধু ব্রিটিশরা বাদে সকলেই এদেশটিকে নিজেদের দেশ বলে মেনে নেয় এবং তদনুযায়ী তারা নিজেদেরকেও নতুনভাবে গড়ে তোলে।”

১৯৭১ সালে বাঙালির জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর বুকে জেগে ওঠে এক নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বিংশ শতাব্দীতে আর কোনো দেশ এমনভাবে একটি মুক্তিযুদ্ধ করে নিজেকে স্বাধীন করেনি। নাইজেরিয়া্র বায়াফ্রা প্রদেশ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

“বিগত শতাব্দীতে প্রায় সব ঔপনিবেশিক শক্তি বিদায় নেওয়ার ফলে অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রেই আন্দোলন বা বিক্ষোভ শেষে সমঝোতার মাধ্যমে উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করে। ফরাসি সাম্রাজ্যের অনেক উপনিবেশে যথেষ্ট দ্বন্দ্বসংঘাত হয়, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়।”

ইতিহাস তুলে ধরে মুহিত লিখেছেন, ঔপনিবেশিক শক্তির প্রত্যাগমনের পর দুটি বিচ্ছিন্ন এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠে স্বাধীন দেশ পাকিস্তান। এ দেশটির জন্মের পেছনে এই ভূখণ্ডের জনগণের ইচ্ছাই ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। এখানকার জনগণই ভারতে স্বতন্ত্র মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে এবং ভৌগলিকভাবে অস্বাভাবিক পাকিস্তান সৃষ্টিতে ব্যাপক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে।

(ফাইল ছবি)

বাংলাদেশের অভ্যূদয় এবং একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী  ১৯৯৬ সালের  ডিসেম্বরে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘স্মৃতি অম্লান ৭১’ এ বিশেষভাবে লেখার কথা জানিয়েছেন তিনি।

“এই ঘটনাপঞ্জি নতুনভাবে সম্পাদিত ‘স্মৃতি অম্লান ৭১’ এও সংযোজিত হচ্ছে। স্মৃতি অম্লানের এই সংস্করণ আমার স্মৃতিকথার তৃতীয় খণ্ড হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই এখানে এ বিষয়ে আর কিছূ না লিখে একাত্তরের ঘটনাপঞ্জি একটু পরেই তুলে ধরছি।

একাত্তরের ঘটনা নিয়ে মুহিত বলেন, “আমি তখন দেশে ছিলাম না তাই সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি এবং সেটা দেখারও সুযোগ পাইনি। তবে পাকিস্তানের সামরিক রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন আলোচনার পথ বন্ধ করে রক্তলোলুপ এক সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালিদের নিধন এবং তাদের দেশ ও সম্পদ ধ্বংসে লেলিয়ে দিলেন, তখন থেকেই বাংলাদেশে পাকিস্তানের সমাধি রচনার কাজ শুরু হয়ে যায় এবং নয় মাসে তার সমাপ্তি ঘটে।

“যুদ্ধে নৃশংসতার এমন নিদর্শন বিংশ শতাব্দীতে আর একটিও ছিল না। একইসঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্বুদ্ধিতাও ছিল অচিন্ত্যনীয়। পাকিস্তান বিংশ শতাব্দীতে গণহত্যার যে রেকর্ড স্থাপন করে তাতে উন্মাদ হিটলারেরও মাথা হেঁট হয়ে যায়। মাত্র নয়মাসে ৩০ লাখ মানুষের হত্যা এবং একটি দেশের দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ ধ্বংসের লজ্জাকার কীর্তির সঙ্গে যুক্ত হয় দুনিয়ার সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীকে পিতৃপুরুষের ভিটা থেকে বিদেশে বিতাড়ন।”

মুহিত লিখেছেন, “নয় মাসে এক কোটি আশ্রয়প্রার্থী প্রতিবেশী ভারতে প্রাণরক্ষার খাতিরে পাড়ি দেয়। প্রতিফলও হয় একই রকমের – বৃহৎ আকারের পরাজয়, সম্মানহানি ও তিরস্কার। ৯১০০০ সৈন্য ও তাদের সহায়ক ছিল যুদ্ধবন্দি এবং এই বন্দিত্বের অবসান হয় যুদ্ধবিরতির প্রায় বছরখানেক পরে।

“তবে পাকিস্তানের সাফল্য ছিল একটি ক্ষেত্রে। একটি সুন্দর নির্বিরোধ শান্তিময় দেশকে এমন ধ্বংস তারা করে যে, সেখান থেকে উঠে দাঁড়াতে বাংলাদেশকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় এবং বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালাতে হয় প্রায় তিনটি বছর। বাংলাদেশের দুর্যোগ একটি আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ত্রাণ প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তোলে ইউএন ডিজাস্টার রিলিফ অর্গানাইজেশন।

“নৃশংসতা বর্বরতা, গণহত্যা, লুটতরাজ ও জনপদ ধ্বংসের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে পাকিস্তান ও তার সেনাবাহিনী। নির্লজ্জ জাতিটি আজও এই বর্বরতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান এখন বিশ্বের ‘বদমায়েশ দেশ’ (Rouge state) এর মধ্যে সম্ভবত প্রথম স্থান দখল করেছে।”

চন্দ্রাবতী একাডেমি প্রকাশিত বইটির দাম রাখা হয়েছে ৬০০ টাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ।

সহধর্মীনি সাবিয়া মুহিতকে বইটি উৎসর্গ করেছেন অর্থমন্ত্রী।