বাহিনীর মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ শুক্রবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরে বলেন, ওই জঙ্গি নেতার প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান, তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
এই জেএমবি নেতার ‘নেতৃত্বেই’ গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি, শোলাকিয়া ঈদগাহ, হোসনি দালান, পুলিশ চেক পোস্ট, বিদেশি নাগরিক হত্যাসহ অন্তত ২২টি জঙ্গি হামলা হয়েছে দাবি করে সেগুলোর তালিকাও দিয়েছে র্যাব।
আব্দুর রহমানই শায়খ আবু ইব্রাহীম আল হানিফ নামে নব্য জেএমবি গঠন করে আমিরের দায়িত্ব নেন জানিয়ে এর প্রমাণ হিসেবে র্যাব প্রধান নব্য জেএমবি কর্মকাণ্ড শুরুর একটি ঘোষণার অনুলিপি সংবাদ সম্মেলনে দেখান।
তিনি বলেন, ওই ঘোষণায় আবু ইব্রাহীমের সঙ্গে শেখ আবু দুজুনা নামে আরেকজনের সই আছে। সেই আবু দুজুনা হলেন নারায়ণগঞ্জের অভিযানে নিহত তামিম চৌধুরী, যাকে এতোদিন নব্য জেএমবির প্রধান সমন্বয়ক বলা হচ্ছিল।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার মহাখালী ও মতিঝিল থেকে নাফিজ আহমেদ নয়ন ও হাসিবুল হাসান নামে দুইজনকে আটকের পর এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন বেনজির।
র্যাব সদরদপ্তরের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই দুইজনের কাছ থেকে ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
“তারা দুজনেই নব্য জেএমবির সদস্য এবং আব্দুর রহমান ওরফে আবু হানিফ ওরঠে ঘনিষ্ঠ সহযোগী,” বলেন তিনি।
গত ৮ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ার এক বাড়িতে র্যাবের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়। সে সময় র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয় নিহত ব্যক্তির নাম আব্দুর রহমান আয়নাল, তিনিই নব্য জেএমবির প্রধান অর্থ যোগানদাতা।
ওই বাসা নিহতের স্ত্রী মোসাম্মত শাহানাজ আক্তার রুমিকে (২৮) আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়; তাদের দুই শিশু সন্তনকে পাঠানো হয় সেইফ হোমে।
র্যাব সারোয়ার ওরফে আবদুর রহমানকে নব্য জেএমবির প্রধান বললেও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, এই দলের সদস্য ও নেতারা নিজেদের কাছে খুব বেশি টাকা রাখতেন না। সংগঠনের বিশ্বস্ত লোকজনের কাছে টাকা জমা রাখতেন। আর আবদুর রহমান তাদেরই একজন।
‘যেভাবে মিলল’ পরিচয়
সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর বলেন, ওই আস্তানায় গিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে জানতে পারেন, নিহত জঙ্গির নাম আবদুর রহমান।
সেই সঙ্গে পাওয়া যায় জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির আইডি কার্ড।
সেগুলো পরীক্ষা করে র্যাব দেখতে পায়, ওই বাসায় পাওয়া এনআইডি ভুয়া। যেসব নামে পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসন্স করা হয়েছে, সেই নামেও কাওকে পাওয়া যায়নি।
পরে বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়ার পর ছবি দেখে তারাই সারোয়ারকে শনাক্ত করেন বলে জানান বেনজীর।
তিনি বলেন, সারোয়ার জাহান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার থুমরিভুজা গ্রামের আব্দুল মান্নান ও ছালেহা বেগমের সন্তান।
সারোয়ার বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি ও উর্দু ভাষায পারদর্শী ছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি মোক্তার, নাজমুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, শায়খ আসিম আজওয়াদ, শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ- এসব নাম ব্যবহার করতেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
নব্য জেএমবির আমির হিসেবে জঙ্গিবাদে ব্যবহৃত অর্থায়নের কিছু হিসাব, একাধিক চিঠি, মেইল, এসএমএস ও অপারেশনের নথিপত্র পাওয়ার কথা জানিয়ে র্যাব প্রধান বলেন, কয়েকটি চিঠিতে এই জঙ্গি নেতা শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নাম ব্যবহার করে সই করেছেন।
“এতে এটাই প্রমাণ করে যে আব্দুর রহমানই হল বর্তমান সময়ের নব্য জেএমবির আমির শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ, যার মূল নাম সারোয়ার জাহান।”
নব্য জেএমবির তিন জন শুরা সদস্য আছে জানিয়ে বেনজীর বলেন, “এদের সাংগঠনিক নাম (ছদ্মনাম) পেয়েছি। তাদের ৩৩ জন অ্যাকটিভ কর্মী ছিল। আটটি অভিযানে তাদের মধ্যে ১২ জন মারা গেছে। জীবিত ২১ জনের মধ্যে ১৯ জন মিড লেভেলের ফাইটার, এদের গ্রেপ্তার করা আমাদের দায়িত্ব।
“মিড লেভেলের ফাইটারের কাছে কোনো অস্ত্র নেই, সব উদ্ধার করেছি। এই ১০-১২ দিনের মধ্যে অস্ত্র সরবারহ করলে বিষয়টি আলাদা।”
সারোয়ার ‘যেভাবে জঙ্গি নেতা’
১৯৯৮ সালে বাড়ি ছেড়ে সারোয়ার নাচোলের একটি কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হন জানিয়ে ব্যাব মহাপরিচালক বলেন, পরে তিনি সেখান থেকে দাওরা পাস করেন।
সারোয়ার দুটি বিয়ে করেছে জানিয়ে বেনজীর বলেন, “প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে সে আরেকটি বিয়ে করে। প্রথম পক্ষে এক মেয়ে এক ছেলে। পরের পক্ষে এক ছেলে আছে, তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৯৯৮ সালে কওমি মাদ্রাসায় ভর্তির পর সারোয়ারের জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন।
২০০৩ সালে চাঁপাইনবগঞ্জের ক্ষেতলালের এক বাড়িতে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে শতাধিক লোক জড়ো হওয়ার খবরে পুলিশ সেখানে যায়। সে সময় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জঙ্গিরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তিনটি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং গুলি করে গ্রেনেড ছুড়ে পালিয়ে যায়।
পুলিশ সেদিন ঘটনাস্থল থেকে ৩৩ জনকে আটক করে, যাদের মধ্যে এই সারোয়ার জাহানও ছিলেন বলে জানান বেনজীর।
সেই এফআইআরের কপি সাংবাদিকদের দেখিয়ে তিনি বলেন, “সারোয়ার ওই এফআইআরে সাত নম্বর আসামি ছিল।”
২০০৩ সালে গ্রেপ্তার হয়ে নয় মাস পর জামিন পান সারোয়ার। এরপর দেড় মাসের মত বাড়িতে অবস্থান করে আত্মগোপনে যান তিনি।
র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৭ সালে বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমান গ্রেপ্তার হলে জেএমবি সাংগঠনিকভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এরপর ২০১৪ সালে পুরাতন জেএমবি ‘নতুন চেতনায় নব্য জেএমবি হিসেবে’ আত্মপ্রকাশ করে।
“নব্য জেএমবির সাধারণ সদস্যরা সারোয়ার জাহানকে শুরা সদস্য মনোনিত করে। পরে মনোনিত অন্য শুরা সদস্যরা তাকে নব্য জেএমবির আমির ঘোষণা করলে তিনি জেএমবির সাংগঠনিক নাম শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।”
র্যাব বলছে, সারোয়ারের পরামর্শে নব্য জেএমবি সদস্যরা ২০১৫ সালের ৩০ অগাস্ট চট্টগ্রামে মিরসরাইয়ের আওয়ামী লীগ নেতা ইমরানকে গুলি করে ৬০ লাখ টাকা ছিনতাই করে। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বাংলা বাজারে নেংটা বাবা ও তার এক সহযোগীকে হত্যা করে তারা।
“মূলত ওই দুটি অপারেশন সফলভাবে পরিচালিত হওয়ায় শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফকে নব্য জেএমবিতে বায়াত দেওয়ার অনুমিত দেয় শুরা সদস্যরা।”
‘সারোয়ারের নির্দেশে’ ২২ হামলা
নব্য জেএমবির আমির সারোয়ারের ‘নেতৃত্বে’ বিদেশি নাগরিক, হোসনি দালান, শোলাকিয়া ঈদগাহ, পুলিশ চেক পোস্ট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ধর্মীয় গুরুসহ অন্তত ২২টি হামলা হওয়ার কথা বলছে র্যাব।
# ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর শুলশানে ইতালীয় নাগরিক চেজার তাভেল্লাকে গুলি করে হত্যা।
# ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে (৬৫) গুলি করে হত্যা।
# পাবনার ঈশ্বরদীতে ফাদার লুক সরকারকে (৫০) হত্যাচেষ্টা।
# গাবতলীর পর্বত সিনেমা হলের সামনে পুলিশ চেক পোস্টে হামলা।
# ঢাকার হোসনি দালানে বোমা হামলা।
# নন্দন পার্কের সামনে পুলিশ চেকপোস্টে কর্মরত শিল্প পুলিশ মুকুল হোসেনকে (২৩) ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা।
# দিনাজপুরে খ্রিস্টান যাজক পিয়েরে পারোলারিকে (৬৪) গুলি করে হত্যার চেষ্টা।
# বগুড়ায় শিয়া মসজিদের এলোপাতাড়ি গুলি করে মসজিদের মুয়াজ্জিম মোয়াজ্জিম হোসেনকে (৬০) হত্যা।
# চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাটিতে বোমা বিস্ফোরণ।
# পঞ্চগড়ে মঠের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর দাশকে (৫০) ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা।
# গাইবান্ধায় ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিককে (৬৮) বাজারে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা।
# নাটোরের বড়াইগ্রামের মুদি ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজকে (৬০) কুপিয়ে হত্যা।
# ঝিনাইদহে পুরোহিত গোপাল গাঙ্গুলীকে (৭০) গলা কেটে হত্যা।
# খ্রিস্টান ধর্মযাজক নিত্যরঞ্জন পাণ্ডেকে (৬০) পাবনা মানসিক হাসপাতালের সামনে কুপিয়ে হত্যা।
# মাদারীপুরের সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা করে হত্যাচেষ্টা।
# ঝিনাইদহে রাধামদন মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে (৬২) কুপিয়ে হত্যা।
# গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা।
# শোলাকিয়ায় পুলিশ চেক পোস্টে হামলা।
এছাড়া এই সারোয়ারের নির্দেশেই কাদিয়ানী মসজিদে বোমা হামলা, পঞ্চগড়ে হিন্দু পুরহিতকে হত্যা, কুড়িগ্রামে খ্রিস্টান পাদ্রী হত্যা এবং ঝিনাইদহে শিয়া ধর্ম প্রচারককে হত্যা করা হয়েছে বলে র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে।
র্যাব বলছে, হলি আর্টিজানে হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে নব্য জেএমবি কোনঠাসা হয়ে পড়লেও ভবিষ্যতে হামলার কিছু পরিকল্পনা সারোয়ারের নথিপত্রে পাওয়া গেছে।
“বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সহায়তায় বাংলাদেশের মধ্যে একটি ‘সেইফ জোন’ তৈরির পরিকল্পনাও সেখানে ছিল।”
এর মধ্যে পশ্চিমা দূতাবাসে হামলা; বিশ্ববিদ্যালযের ভিন্ন মতাবলম্বী শিক্ষকদের উঠিয়ে এনে হত্যা; গ্রামাঞ্চেলের থানা লুট; পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে হত্যা এবং অস্ত্র ও পোশাক লুটের পরিকল্পনাও নব্য জেএমবির ছিল বলে র্যাবের ভাষ্য।
সারোয়ারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় অধীনস্তরা দিকনির্দেশনা নিত জানিয়ে গত ২৭ অগাস্ট জঙ্গি তামিমের সঙ্গে সারোয়ারের বিনিময় হওয়া ‘প্রোটেকটেড টেক্সট’ এর একটি নমুনাও সাংবাদিকদের দেখানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
র্যাব বলছে, সারোয়ারের অন্যতম সহযোগী ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক রোকন ৬০ থেকে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে নব্য জেএমবিকে সহায়তা করেছেন, যিনি গত বছরের শুরু থেকে পরিবার নিয়ে নিরুদ্দেশ।