স্মার্টকার্ড যুগে বাংলাদেশ

আইরিশের প্রতিচ্ছবি এবং দশ আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে নিজের ‘স্মার্টকার্ড’ নেওয়ার মধ‌্য দিয়ে বাংলাদেশের নাগরকিদের হাতে উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2016, 06:31 AM
Updated : 3 Oct 2016, 05:58 AM

রোববার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করে তিনি বলেছেন, “আমাদের জাতীয় জীবনে আজ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে।”

দেশের প্রায় ১০ কোটি ভোটারের মধ্যে মোটামুটি নয় কোটির হাতে লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা পেতে এই জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

তাদের সেই পুরনো পরিচয়পত্র ফিরিয়ে নিয়ে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর সোমবার থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এবং প্রত্যন্ত এলাকা কুড়িগ্রামে এই কার্ড বিতরণ শুরু হবে।

সকালে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়েই প্রধানমন্ত্রী আইরিশের প্রতিচ্ছবি এবং দশ আঙ্গুলের ছাপ দেন। পরে পুরনো ভোটার আইডি কার্ডটি ফেরত দেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্মার্ট কার্ডটি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কাছে হস্তান্তর করেন।

এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধানমন্ত্রীর হাতে তার স্মার্টকার্ডটি তুলে দেন। কাজী রকিব পরে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির স্মার্টকার্ডটিও হস্তান্তর করেন।

পরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদ, মুস্তাফিজুর রহমান, সাব্বির রহমান, তাসকিন আহমেদ, সৌম্য সরকার, নাসির হোসেন, ইমরুল কায়েস ও তাইজুল ইসলাম এ অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তাদের স্মার্টকার্ড বুঝে নেন। পুরনো ভোটার আইডি তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ফিরিয়ে দেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতীয় পরিচয়পত্র যাতে কেবল ভোটারের জন্য নয়, বহুবিধ ব্যবহার যেন হয়, সে সুযোগ সৃষ্টির জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। নাগরিক হিসাবে সঠিক সেবাটা ঠিকমতো নেওয়ার জন্য এই পরিচয়পত্র।”

স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও অপরাধীকে দ্রুত শনাক্ত করা এবং গ্রেপ্তার করার সহজ হবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমি অনুরোধ করব নির্বাচন কমিশনকে যে ডাটাগুলো নেওয়া হচ্ছে তার নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়। প্রত্যেকটা তথ্যের নিরাপত্তার জন‌্য ফায়ারওয়ালসহ যে প্রযুক্তি প্রয়োজন- সেটা থাকতে হবে। যাতে কেউ কোনোভাবে এই তথ্যের অপব্যবহার করতে না পারে।”

শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমানে যারা ভোট দিতে পারে অর্থাৎ ১৮ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী, তাদেরকেই পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। তবে যাদের বয়স ১৮ বছরের কম, যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হয়নি, তাদেরও জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে এবং বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছবি তোলেন প্রধানমন্ত্রী।

যেসব তথ‌্য থাকবে স্মার্টকার্ডে: নাগরিকের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, পেশা, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা, বয়স, জন্মতারিখ, রক্তের গ্রুপ, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, দৃশ্যমান শনাক্তকরণ চিহ্ন, ধর্ম, জন্মস্থান, জন্ম নিবন্ধন সনদ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, আয়কর সনদ নম্বর, টেলিফোন নম্বর, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, স্বামী বা স্ত্রীর নাম ও পরিচয়পত্র নম্বর, প্রতিবন্ধী হলে সেই তথ্য স্মার্টকার্ডে থাকবে।

যেভাবে বিতরণ: প্রথম পর্যায়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও কুড়িগ্রাম; দ্বিতীয় পর্যায়ে খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন; তৃতীয় পর্যায়ে ৬৪টি সদর উপজেলা এবং চতুর্থ পর্যায়ে বাকি সব উপজেলায় দেশজুড়ে স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হবে।

প্রথমে ঢাকার উত্তরার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৬৩ হাজারেরও বেশি ভোটারের কাছে পরীক্ষামূলকভাবে স্মার্ড কার্ড বিতরণ শুরু হবে। ৩ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত উত্তরা হাই স্কুল ও কলেজে বিতরণকাজ চলবে। আর ঢাকা দক্ষিণে রমনা থানার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটাররা সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুল ও কলেজ, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটাররা সেগুন বাগিচা হাই স্কুল এবং ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটাররা উদয়ন স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে ৩ অক্টোবর থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত স্মার্ট কার্ড নিতে পারবেন।

যাদের লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয় নেই তারা নির্ধারিত স্লিপ দিয়ে এনআইডি নম্বর জেনে বিতরণ কেন্দ্রে গেলেই স্মার্টকার্ড দেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এবং মাইকিং, ব্যানার, ফেস্টুন দিয়ে প্রচারের মাধ‌্যমে বিতরণের দিন তারিখ ও স্থান জানিয়ে দেবে নির্বাচন কমিশন।

ব‌্যবহার: আয়কর দাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) প্রাপ্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর প্রাপ্তি ও নবায়ন, পাসপোর্ট প্রাপ্তি ও নবায়ন, চাকরির জন্য আবেদন, স্থাবর সম্পত্তি কেনা-বেচা, ব্যাংক হিসাব খোলা ও ঋণ প্রাপ্তি, সরকারি বিভিন্ন ভাতা উত্তোলন, সরকারি ভর্তুকি, সাহায্য, সহায়তা প্রাপ্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, বিমানবন্দরে ই-গেইট এর মাধ্যমে আগমন ও বহির্গমন সুবিধা, শেয়ার আবেদন ও বিও অ‌্যাকাউন্ট খোলা, ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ গ্রহণ, মোবাইল ও টেলিফোন সংযোগ গ্রহণ, বিভিন্ন ধরনের ই-টিকেটিং, সিকিউরড ওয়েব লগ ইন, ই-ফরম পূরণে নাগরিকের সঠিক ও নির্ভুল তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযোজনের কাজে ১০ ডিজিটের এই স্মার্টকার্ড ব‌্যবহার করা যাবে।

ডায়াল ১০৫: জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য জানাতে একটি হেল্প ডেস্ক খুলেছে এআইডি উইং। যে কোনো ফোন থেকে ১০৫ নম্বরে কল করলে নাগরিকদের তথ্য জানাবে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তারা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব‌্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে ঢাকার দুটি থানার জন্য ৫৫ জন অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উত্তরায় ৩০ জন এবং রমনার জন্য ২৫ জন অপারেটর স্মার্টকার্ড বিতরণে কাজ করবেন।

সোমবার রাজধানীতে পাইলট কার্যক্রম শুরুর পাশাপাশি কড়িগ্রামেও বিতরণ শুরু হবে। বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিতরণ কাজের উদ্বোধন করবেন।

এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দীন জানান, এই স্মার্টকার্ড ভবিষ্যতে ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।

স্মার্ট কার্ডের কারিগরি দিক এবং এর ব‌্যবহার নিয়ে দুটি ভিডিওচিত্র দেখানো হয় অনুষ্ঠানে।

অন‌্যদের মধ‌্যে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি চিমিয়াও ফান এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ অনুষ্ঠানে বক্তব‌্য দেন।