‘অনেক লেখা বাকি রেখে’ চলে গেলেন সৈয়দ হক

কবিতা, নাটক, উপন্যাস সাহিত্যের সব শাখায় হাত দিয়ে সফল সৈয়দ শামসুল হক জীবনের শেষ দিনগুলোতেও ক্রমাগত লিখে যাচ্ছিলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকজ্যেষ্ঠ ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2016, 02:39 PM
Updated : 27 Sept 2016, 04:49 PM

জীবনের শেষ দিনগুলোতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ল্যাপটপে কখনও নিজে কম্পোজ করেছেন, কখনও কাগজে লিখেছেন, আবার কখনও অন্যকে ডিকটেশন দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সে সময়ে তার কাছে থাকা মানুষেরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটা গান লিখে গেছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত।

এখনও অনেক লেখা বাকি থাকার কথা জানিয়ে সৈয়দ শামসুল হক নশ্বর এই পৃথিবী ছেড়ে গেলেন বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

সৈয়দ হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ এ যে অঞ্চলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক, সেই ভূমি থেকেই আসা নূরের কণ্ঠে অসংখ্যবার ধ্বনিত হয়েছে নূরলের আহ্বান। নাটকটিতে অভিনয়ও করেছেন তিনি।

লেখকের শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর শুনে মঙ্গলবার সকালে ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে তাকে দেখে আসেন মন্ত্রী। মৃত্যুর খবর শুনে সন্ধ্যায় ফের হাসপাতালে ছুটে যান তিনি। এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় তাকে।

“তাকে এত দ্রুত হারাব-সেটা আমরা ভাবিনি। বাংলাদেশের মানুষের আয়ুতো এখন বেড়েছে। আর তার মতো একজন সৃজনশীল মানুষ, যিনি কয়দিন আগেও একজন সুস্থ মানুষের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন...,” বলেন আসাদুজ্জামান নূর।

সৈয়দ শামসুল হক

ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে চিকিৎসার জন্য এপ্রিলে লন্ডন যাওয়ার পর ক্যান্সার ধরা পড়ে সৈয়দ হকের। তিন মাস চিকিৎসার পর গত ১ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন তিনি।

যুক্তরাজ্যে কবিকে দেখার কথা জানিয়ে নূর বলেন, “উনি লন্ডন থেকে যখন এলেন, তার দুইদিন আগেও তার সঙ্গে দেখা করেছি। উনি এত আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন যে, তার শারীরিক যে অবস্থা আমি লক্ষ করেছি, তাতে আমি মনে করেছি, উনি ফিরে আসবেন।

“ওই সময়ে উনি ক্রমাগত লিখে যাচ্ছিলেন। উনি প্রতি মুহূর্তে বলছিলেন, ‘আমার এখনো অনেক লেখা বাকি। মাথার মধ্যে অনেক লেখা জমা হয়ে আছে।’ আমরাও ভাবছিলাম, নিশ্চয়ই উনি লেখাগুলো শেষ করে যাবেন। কিন্তু শেষ না করেই উনি চলে গেলেন।”

এভাবে লেখকের চলে যাওয়া বাঙালির জন্য অনেক বড় ক্ষতি বলে মনে করেন করছেন সংস্কৃতি কর্মী আসাদুজ্জামান নূর।

“তারপরও উনি যা দিয়ে গেছেন, রবীন্দ্রনাথের পরে এত বিষয় নিয়ে আর দ্বিতীয় কোনো লেখক বাংলা সাহিত্যে আছে বলে আমার মনে হয় না। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কলাম, সাংবাদিক হিসাবে রচনা, চিত্রনাট্য, সংগীত, পরিচালনা-এত বহুমুখী প্রতিভা বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার মনে হয় না।

“তার প্রতিটি কাজের মান অত্যন্ত উঁচু। এত উঁচু মান বজায় রেখে এত বিচিত্র বিষয়ে সৃষ্টি করা একজন অতি মানবের পক্ষেই সম্ভব। তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন অতি মানবও বটে,” সব্যসাচী লেখকের মূল্যায়নে বলেন তিনি।

জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত বলেন, “কম্পিউটারে লেখালেখির শুরু থেকেই তিনি কম্পিউটারে লিখতেন। হাসপাতালের শয্যায় শুয়েও গত কয়েকদিন আগে উনি ইচ্ছা পোষণ করলেন যে, উনি কম্পিউটারে লিখবেন। সেটা শুরু করেছিলেন।

“বেশ কিছু নাটকের কাজ শুরু করেছিলেন, সেগুলো তিনি কম্পিউটারে লেখা শুরু করেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য অনেক অসমাপ্ত কাজ রেখে তাকে চলে যেতে হয়েছে। নানান মাধ্যমে উনি যে বিপুল পরিমাণ কাজ রেখে গেছেন, সে কারণেই আমরা তাকে সব্যসাচী লেখক বলি। গীতিকার হিসাবেও তিনি সফল। প্রথম যৌবনে চলচ্চিত্র নিয়েও বহু কাজ করেছিলেন।

“জাতীয় কবিতা পরিষদের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে উনার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলাম। সেখানে  ‘দৃষ্টিভূতিতে দীর্ঘ ছায়া’ শিরোনামে প্রায় ৬ হাজার শব্দে একটি বক্তৃতা তিনি প্রদান করেছিলেন। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানের তিনি একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন, যা পরে ‘সভ্যতার সংকট’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পাই।

“শামসুল হকের সেই প্রবন্ধটি বহু বছর বাংলা সাহিত্যে যারা কাজ করবেন, তাদের অনুপ্রেরণা দিবে। উনি নিজেকে বাহান্নর সন্তান বলতে ভালোবাসতেন। উনার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সংকলিত ২১ ফেব্রুয়ারি সংকলনে। সেই সময় থেকে আমরা বলি, রক্ত রেখার আলপনা আঁকা পথের যাত্রী।”

প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে সৈয়দ হক একটি গান লিখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “‘আহা কী আনন্দ....’ পুরো গানটি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন। কয়েকদিন আগে উনার সাথে দেখা করতে আসার পর উনি বললেন, আমি বলছি, গানটি লিখে নাও। উনি ডিকটেশন দিলেন। এত সুন্দর!

“গত ১৫ দিনে উনি প্রায় ২০টির উপরে লেখা লিখেছেন। এর রকম একটা দুরারোগ্য ব্যধির মধ্যেও উনি উনার লেখালেখি চালিয়ে নিয়েছিলেন। উনি প্রায় দুইশ’র মতো কবিতা লিখেছেন। কী পরিমাণ মানসিক শক্তি, এটাকে অসাধারণও বলতে পারেন।

গীতিকার মাযহারুল আনোয়ার বলেন, “সৈয়দ হক শেষ দেখায় বলেছিলেন, তিনি বাঁচতে চান একশ বছর। কিন্তু তিনি বাঁচলেন না। চলচ্চিত্র আর গান, কবিতা সব কিছুতেই তিনি মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার কথা বলেছেন।

‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’ আয়োজিত এক সভায় সৈয়দ শামসুল হক। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

“একজন শিল্পী কখনও প্রাপ্তির জন্য কাজ করেন না, কাজ করেন আত্মতৃপ্তির জন্য। সৈয়দ শামসুল হকও তেমনই এক শিল্পী।”

সৈয়দ হককে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের ‘শিক্ষক’ বলে মন্তব্য করেন কবি মুহাম্মদ সামাদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, “রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের একজন মহান শিক্ষক। তারপরে যারা বাংলা সাহিত্যকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষক হিসাবে সমৃদ্ধ করেছেন, তার মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ও সৈয়দ শামসুল হক।

“তিনি (সৈয়দ হক) কবি, গল্পকার, নাট্যকার, সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, গান লিখেছেন, ভাস্কর্য করেছেন, ছবি এঁকেছেন- এমন বহুমুখী প্রতিভার লোক রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয় কেউ নাই।

“এত বড় লেখকের বিদায় অপূরণীয় ক্ষতি। এত সহজে এটা পূরণ হবে না, সম্ভব না। সে রকম মেধাবী লোক চোখের সামনে কেউ পড়ে না।”

সৈয়দ হক মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, স্বাধীনতার প্রশ্নে, স্বাধীনতার মূল্যেবোধের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।

বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে লেখকের সঙ্গে কাজ করার স্মৃতিচারণ করে সংস্কৃতিকর্মী তারানা বলেন, “সৈয়দ শামসুল হককে শুধু একজন কবি বা সাহিত্যিক হিসেবে দেখি না, তিনি সব সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, স্বাধীনতার প্রশ্নে, স্বাধীনতার মূল্যেবোধের প্রশ্নে আপসহীন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

“আমরা যত আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, যখনই তাকে ডেকেছি তখনই তিনি আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন এবং থেকেছেন।”

রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবিচল ছিলেন বলে মন্তব্য করেন তারানা।

তিনি বলেন, “একটি ধারণা মানুষের মাঝে কাজ করে একজন কবি শিল্পী, সাহিত্যিকের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকে কি না বা কেন থাকবে, উনি কিন্তু সেটার ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করেছেন।

“যেমন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারাভিযান বা বিভিন্ন প্রয়োজনে তিনি একটি নিরপেক্ষ অবস্থায় থেকে কাজ করেছেন। আমাদের সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলেন বা আমাদের প্রগতিশীল আন্দোলনে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য এই জায়গায় তিনি নিজেকে কবি শামসুল হক বা সব্যসাচী লেখকের চেয়েও অনেক উঁচু জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাকে আমরা ওইভাবেই দেখতাম।

“অনেক আন্দোলন সংগ্রামে অনেক সময় দেখা গেছে অনেকে বিভিন্ন সময় আসতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন, এখানে গেলে হয়ত বা মনে হতে পারে আমি একটি বিশেষ দলের, তিনি কিন্তু সেই গণ্ডি ভেঙে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন।”

সৈয়দ শামসুল হক একটা বিশেষ নির্ভরশীলতার জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন বলে মনে করেন তারানা হালিম।

“তার চলে যাওয়াটা আকস্মিক, আকস্মিক এই অর্থে যে আমরা সব সময় আশা করি ‘মিরাকল’ কিছু একটা ঘটবে। উনার অসুস্থতার খবর খুবই আকস্মিক ছিল। আমরা আশা করেছিলাম, উনি আরও কিছু দিন আমাদের মাঝে থাকবেন।

সৈয়দ হক শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন মন্তব্য করে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, “শেষ মুহূর্ত অবধি তিনি শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ভেবেছেন।”

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার তিন যুগ পূর্তিতে ২০১৪ সালের ৫ মে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করেন লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ছবি: নয়ন কুমার/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শিল্পকলায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হকের বিকল্প খুঁজে পান না নাট্যব্যক্তিত্ব তারিক আনাম খান। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’সহ সৈয়দ হকের লেখা বেশ কটি নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

“হক ভাই কদিন আগেই তো হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলেন, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো। ভাবিনি তিনি এত দ্রুত চলে যাবেন। সত্যি এই ক্ষতি অপূরণীয়।”

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব- উল- আলম হানিফ বলেন, “কবি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। কিন্তু রেখে গেছেন তার অমর সব সৃষ্টি। তার চলে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি, যা কখনও পোষাবার নয়।”

সৈয়দ হকের সৃষ্টিকর্ম যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যায় সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

ক্ষমতাসীন দলটির আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, “প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন, তার পক্ষ থেকে আমরা যাবতীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।

“প্রধানমন্ত্রী তার সাথে এখানে দেখা করে গেছেন। শেষ ইচ্ছা বলেছেন, ছোট বেলার সেই স্কুল আজ কলেজে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেছেন, সেই স্কুলের খোলা ধানক্ষেতে যেন তাকে সমাহিত করা হয়। আমরা সেই ব্যবস্থা নিয়েছি। তাকে সেখানে নিয়ে যেতে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছেন।”

নানক বলেন, “উনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার একজন অভিভাবক ছিলেন। বিছানায় শয্যাশায়ী হওয়ার পরও তিনি ১৭০টির মতো কবিতা এবং চারটির মতো উপন্যাস লিখেছেন বলে আমি শুনেছি।”

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী বলেন, “এ ধরনের লেখক আর কখনও জন্মগ্রহণ করবেন না।”

সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুতের ‘অনেক যুগ আর শতাব্দীর অবসান হল’ বলে মন্তব্য করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক।