৪ বছরের বিচারে ঝুললেন ‘বাঙালি খান’

ফাঁসির দড়িতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একাত্তরের বদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলীর গ্রেপ্তারের পর বিচার শেষ হতে সময় লেগেছে চার বছরেরও বেশি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2016, 04:42 PM
Updated : 3 Sept 2016, 09:28 PM

একাত্তরে ‍যুদ্ধ শুরুর সময় চট্টগ্রাম নগর ছাত্রসংঘের এই সভাপতি সেখানে ‘ডালিম হোটেলে’ নির্যাতন ক্যাম্প বানিয়ে যে ‘সফলতার’ পরিচয় দেন, তাতে যুদ্ধ চলাকালেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক পদে তার পদোন্নতি হয়।

স্বাধীনতার পরও তার ওপর আস্থা রাখতে দেখা যায় জামায়াত নেতাদের। ১৯৭৭ সালে ছাত্র সংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির হিসাবে কাজ শুরু করলে নতুন সংগঠনের সভাপতি হন মীর কাসেম।

১৯৮০ সালে কাসেম যখন সরাসরি জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেন, তখন তিনি রাবেতা আলম আল-ইসলামী নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ সমন্বয়ক। বলা হয়, সেই সময় থেকেই তিনি জামায়াতের আর্থিক ভিত্তি মজবুত করতে কাজ করে আসছেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই সংস্থাটি জঙ্গিবাদ উসকে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১২ সালের ১৭ জুন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া মীর কাসেমের আগে জামায়াতের আরও ছয়জন নেতা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়েছে।

আমৃত্যু কারাবাসের দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারেই মৃত্যু হয়েছে রাজাকারগুরু গোলাম আযমের। আর যুদ্ধাপরাধেরে অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড পেলেও আপিলে সাজা কমে যাবজ্জীবন পাওয়া দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রয়েছেন কারাগারে।

তার সাজা কমানোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা পুনর্বিবেচনার আবেদন বিবেচনাধীন রয়েছে আপিল বিভাগে। খালাস চেয়ে সাঈদীর একটি আবেদনও সেখানে রয়েছে।

জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা মীর কাসেম দলটির অধিকাংশ করপোরেট উদ্যোগের পেছনের ব্যক্তি। জামায়াত সমর্থক বলে পরিচিত দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।

সর্বোচ্চ দণ্ড থেকে রেহাই পেতে সর্বশেষ আইনি লড়াই রিভিউয়ের শুনানিতে কাসেমের আইনজীবী তাকে ইসলামী ব্যাংক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের উদ্যোক্তা হিসেবে উল্লেখ করেন। ওই অবস্থানকে ‘অবদান’ হিসেবে দেখিয়ে তাকে ‘নিষ্কলুষ’ প্রমাণের চেষ্টা করেন। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে রয়েছে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কাসেমের বিচার শুরুর পর ২০১৩ সালের ৬ মে প্রথম প্রহরে ‘লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ ও দাঙ্গা লাগানোর মত পরিস্থিতি সৃষ্টি’র অভিযোগে বন্ধ হয়ে যায় তার প্রতিষ্ঠিত দিগন্ত টেলিভিশন।

মীর কাসেমের অন্যতম উদ্যোগ ইবনে সিনায় চিকিৎসায় অবহেলার কারণে ২০১১ সালে হাই কোর্ট তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিল। আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ নিয়ে সেই সময় তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছিলেন। কর ফাঁকির অভিযোগেও এর আগে মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন রাজধানীর মতিঝিলের নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

চার বছরের পরিক্রমা

২০১২

১৭ জুন: যুদ্ধাপরাধের সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসাবে তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

ওইদিন বিকেলে মতিঝিলে দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের মালিকানাধীন নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেম আলীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে ওইদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

১৯ জুন: মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মীর কাসেমের জামিন আবেদন নাকচ করে ট্রাইব্যুনাল।

১৫ সেপ্টেম্বর: প্রথম দফায় সেইফহোমে জিজ্ঞাসাবাদ।

১২ নভেম্বর: দ্বিতীয় দফা সেইফহোমে জিজ্ঞাসাবাদ।

২০১৩

২ মে:  মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেয় তদন্ত সংস্থা।

১৬ মে: প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। তাতে আনা হয় ১৪টি অভিযোগ।

২৬ মে: ১৪ অভিযোগই আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

২১ আগস্ট: অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়।

৫ সেপ্টেম্বর: হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ১৪ অপরাধে অভিযুক্ত করে মীর কাসেম আলীর বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল-১।

৩০ সেপ্টেম্বর: মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করার আদেশ হয়।

১৮ নভেম্বর: ট্রাইব্যুনাল-২ এ প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্য দিয়ে শুরু হয় মামলার শুনানি।

১১ ডিসেম্বর: মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান শুরু হয়।

২০১৪

১৭ এপ্রিল: প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা শেষ হয়। তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলামসহ মোট ২৪ জন সাক্ষ্য দেন প্রসিকিউশনের পক্ষে।

২১ এপ্রিল: সাফাই সাক্ষ্য শুরু।

২২ এপ্রিল: মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য শেষ। ছোট বোন মমতাজ নুরুদ্দিনসহ মোট তিনজন সাক্ষ্য দেন আসামির পক্ষে।

৪ মে: সাক্ষ্য-জেরা এবং দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে আদালত।

যুদ্ধাপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর কারাগারে যাওয়ার প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় `ভি' চিহ্ন দেখান মীর কাসেম আলী

নভেম্বর: একাত্তরে চট্টগ্রামে নৃশংসতা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টিকারী আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগের মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ আটজনকে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় এই ফাঁসির রায় আসে।

৩০ নভেম্বর: কাসেম আলী ওই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন, যাতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চান তিনি।

২০১৫

২১ এপ্রিল: কাসেমের আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পরদিনের কার্যতালিকায় আসে।

২২ এপ্রিল: আপিলের সার সংক্ষেপ জমা দিতে নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

২৮ মে: আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে সময় বাড়ায় আদালত।

১৮ অগাস্ট: আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ।

২০১৬

৪ জানুয়ারি: মীর কাসেমের আপিল শুনানির জন্য পরদিনের কার্যতালিকায় আসে।

৫ জানুয়ারি: আসামিপক্ষের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড আদালতকে জানায়, তাদের পক্ষে কোন আইনজীবী শুনানি করবেন, তা চূড়ান্ত হয়নি।

৬ জানুয়ারি: শুনানি শুরুর জন্য ২ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেয় আদালত।

২ ফেব্রুয়ারি: আসামিপক্ষের আবেদনে আপিল শুনানি ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পেছানো হয়।

৯ ফেব্রুয়ারি: আপিল শুনানি শুরু।

২৩ ফেব্রুয়ারি: এ মামলায় তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করে আপিল বিভাগ।

২৪ ফেব্রুয়ারি: আপিল শুনানি শেষ, রায়ের দিন ঠিক করে দেয় আপিল বিভাগ।

৫ মার্চ: মীর কাসেমের আপিলের পুনঃশুনানি চেয়ে বক্তব্য দেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হোসেন।

মার্চ: আপিলের রায়েও বহাল থাকে মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার আদেশ।

লাল সালুতে মোড়ানো যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের মৃত্যু পরোয়ানা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গত ৬ জুন সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

৬ জুন: বিচারকরা সই করার পর ২৪৪ পৃষ্ঠার সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। তা হাতে পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আসামির বিরুদ্ধে জারি করে মৃত্যু পরোয়ানা, যার মধ্য দিয়ে সাজা কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরুর পথ তৈরি হয়।

৭ জুন: লাল সালুতে মোড়া সেই পরোয়ানা ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ঘুরে কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছালে তা ফাঁসির আসামি মীর কাসেমকে পড়ে শোনানো হয়। শুরু হয় রিভিউ আবেদনের জন্য ১৫ দিনের ক্ষণ গণনা।

১৯ জুন: খালাস চেয়ে আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন মীর কাসেম।

২১ জুন: রিভিউ আবেদন শুনানির দিন ধার্যের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে চেম্বার বিচারপতি নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।

২৫ জুলাই: রিভিউ কার্যতালিকায় এলে আসামিপক্ষের আইনজীবীর আবেদনে প্রস্তুতির জন্য তাকে এক মাস সময় দেওয়া হয়।

৬ অগাস্ট: আইনজীবী হিসেবে কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম ওরফে আরমান এবং অপর আইনজীবী সাইয়েদ মো. রায়হান উদ্দিন কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করেন।

৯ অগাস্ট: আরমানকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করে তার পরিবার।

২৪ অগাস্ট: মীর কাসেমের রিভিউ শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। তবে এর আগেই কাসেমের ছেলে আরমানের কাছে সব কাগজপত্র রয়েছে দাবি করে শুনানি পেছানোর আবেদন করেন কাসেমের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব। তবে আদালতের আদেশে শেষ পর্যন্ত শুনানি শুরু করেন এই আইনজীবী।

২৮ অগাস্ট: দুই পক্ষ রিভিউ শুনানি শেষ করে।

৩০ অগাস্ট: প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ মীর কাসেমের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিলে এ মামলার সব বিচারিক প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে। সন্ধ্যায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে তা ট্রাইব্যুনাল হয়ে পাঠানো হয় কারাগারে।

৩১ অগাস্ট: রিভিউ খারেজের রায় ফাঁসির আসামি কাসেমকে পড়ে শুনিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ জানতে চায়- তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না। দুপুরে পরিবারের সদস্যরা কারাগারে গিয়ে কাসেমের সঙ্গে দেখা করেন। পরে তার স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন বলেন, তাদের ‘তুলে নেওয়া’ ছেলেকে না পাওয়া পর্যন্ত প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না।

১ সেপ্টেম্বর: প্রাণভিক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আবারও সময় চান কাসেম।

২ সেপ্টেম্বর: মীর কাসেম আলী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানান।

ফাঁসির রাতে কাশিমপুর কারাগারের বাইরে উচ্ছ্বাস

 

৩ সেপ্টেম্বর: কারা কর্তৃপক্ষের ডাক পেয়ে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে মীর কাসেমের সঙ্গে শেষ দেখা করেন পরিবারের সদস্যরা। কাসেমের ফাঁসি কার্যকরের নির্বাহী আদেশ কারাগারে পৌঁছায়।

রাতে কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয় যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড।