নিহত ‘জঙ্গিদের’ মধ্যে মোনায়েম খানের নাতি

আজীবন পাকিস্তানের পক্ষে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী মোনায়েম খানের এক নাতিকে পাওয়া গেছে ঢাকার কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহতদের মধ্যে।

কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2016, 03:58 PM
Updated : 29 July 2016, 02:45 AM

তাজ মঞ্জিলে অভিযানে নিহত নয় যুবকের মধ্যে আকিফুজ্জামান খান (২৪) মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত মোনায়েম খানের নাতি বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম।

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর মঙ্গলবারের অভিযানে নিহত আকিফুজ্জামানসহ নয়জনই জেএমবির সদস্য বলে পুলিশের দাবি। এদের মধ্যে একজন রায়হান কবির ওরফে তারেক সংগঠনটির ঢাকা অঞ্চলের প্রধান বলেও জানানো হয়েছে।

সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার পেছনে একাত্তর ও পঁচাত্তরের পরাজিত শক্তি রয়েছে বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে নিহত ‘জঙ্গিদের’ মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী মোনায়েম খানের নাতির সন্ধান মিলল।

তবে নিহত সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মধ্যে এর আগে আওয়ামী লীগ নেতার সন্তানকেও পাওয়া গেছে।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের মোনায়েম খান ছিলেন মুসলিম লীগের বড় নেতা। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব পেয়ে বাংলার মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন দমনে আইয়ুব খানের হাতিয়ার ছিলেন মোনায়েম খান। 

মোনায়েম খান

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতায় নামা মোনায়েম খান ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকার বনানীর বাসায় মুক্তিবাহিনীর গুলিতে আহত হন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এই পরিবারকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন- এমন একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আকিফুজ্জামান মোনায়েম খানের ছোট ছেলের পুত্র।”

গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় জড়িত কয়েকজনের মতো আকিফুজ্জামানও পড়তেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আকিফুজ্জামানের সঙ্গে নিহত ঢাকার অন্য দুজন সেজাদ রউফ এবং তাজ-উল-হক রাশিকও বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র ছিলেন।

নিহত হওয়ার একদিন পর বুধবার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং আঙুলের ছাপ মিলিয়ে আকিফুজ্জামান সাতজনকে শনাক্তের কথা জানায় পুলিশ। এরপর বৃহস্পতিবার রায়হানকে শনাক্তের কথা জানানো হয়।

পুলিশের সরবরাহ করা তথ্যে বলা হয়, লাশের চতুর্থ ছবিটি আকিফুজ্জামান খানের। তিনি গুলশানের ১০ নম্বর সড়কের ২৫ নম্বর বাড়ির সাইফুজ্জামান খানের ছেলে।   

বৃহস্পতিবার সকালে দোতলা ওই বাড়িতে গিয়ে ‘কলিং বেল’ চাপলেও দীর্ঘক্ষণ কারও সাড়া পাওয়া যায়নি। অনেকক্ষণ পর একজন নারী দরজা খুলেই বলেন, “এই পরিস্থিতিতে কী কথা বলা যায়।”

ফটক থেকে প্রায় ১০ ফুট দূরে বাড়ির দরজা খুলে ওই নারী বিরক্তভরে আরও কিছু বললেও তা স্পষ্ট বোঝা যায়নি। কিছু কথা বলেই তিনি দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যান।

আকিফুজ্জামান খান

বাড়িটির দক্ষিণপাশে একটি ভবনের নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “এই বাসায় তেমন কেউ আসত না। কোনো গাড়িও ঢুকতে দেখি না।”

বাড়িটিতে মানুষের আনাগোনা যে কম, তা প্রধান ফটকের ভেতরের স্থানটুকুতে ধুলার স্তর দেখলেই বোঝা যায়। চার দিক থেকে ঘুরে মনে হয়, নিচতলায় কেউ থাকে না। তবে দোতলায় থাকে।

আকিফুজ্জামান সম্পর্কে আর কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

দুপুরে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল সাংবাদিকদের বলেন, “কল্যাণপুর অভিযানে নিহত জঙ্গি আকিফুজ্জামান পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মোনায়েম খানের নাতি। তিনি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।”

আকিফুজ্জামানের মতোই নর্থসাউথের আরেক শিক্ষার্থী তাজ-উল-হক রাশিকের বাসা ধানমণ্ডির ১১/এ নম্বর সড়কে। পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায় থাকা রবিউল হকের দুই ছেলের মধ্যে রাশিক ছোট।

ওই ভবনের তত্ত্বাবধায়ক আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাশিকের বৃদ্ধ বাবা-মা কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। তার বাবা অনেক অসুস্থ। মাঝে মাঝে বড় ছেলে রাজীব তাকে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা দিয়ে নিয়ে আসেন।”

রাশিক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এক বছর ধরে তাকে দেখি না। তিনি চট্গ্রামে চাকরি করতেন বলে শুনেছি।”

তাজ-উল-হক রাশিক

নর্থসাউথের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের রাশিক সম্পর্কে এক প্রতিবেশী বলেন, “শান্ত স্বভাবেরই ছিল ছেলেটি, তবে দেড় বছর আগে দেখলাম, সে দাড়ি রাখতে শুরু করেছে।”

আকিফুজ্জামান ও রাশিকের সঙ্গে নিহত ঢাকার অন্য যুবক সেজাদ রউফ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান আবদুর রউফের নাতি। তার বাবা তৌহিদ রউফও সেনাবাহিনীর ঠিকাদার ছিলেন।

সেজাদ গত ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন। ওই সময় থেকে নিখোঁজ ছিলেন গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী নিবরাজ ইসলাম। নিবরাজও পড়তেন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কল্যাণপুরে নিহত রায়হান কবির ওরফে তারেক জেএমবির ঢাকা অঞ্চলের সমন্বয়েকের দায়িত্ব পালন করছিলেন বলে পুলিশ জানায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গিদের গাইবান্ধার চরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি।

নিহত অন্যরা হলেন দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থানার ব্ল্লভপুর গ্রামের সোহরাব আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ, পটুয়াখালীর কুয়াকাটার নুরুল ইসলামের ছেলে আবু হাকিম নাইম, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ওমরপুর গ্রামের নাসিরউদ্দিন সরদারের ছেলে সপ্তম ছবিটি মতিয়ার রহমান, নোয়াখালীর সুধারাম থানার পশ্চিম মাইজদীর আবদুল্লাহ মেম্বারের বাড়ির আব্দুল কাইউমের ছেলে জোবায়ের হোসেন।