কল্যাণপুরের ‘জঙ্গিদের’ মুখে ছিল আইএস বুলি: প্রত্যক্ষদর্শী

কল্যাণপুরের যে বাড়িতে সন্দেহভাজন নয় জঙ্গি নিহত হয়েছেন, অভিযানের সময় তারা নিজেদের ‘আইএস সদস্য’ বলে পরিচয় দিচ্ছিলেন বলে দাবি করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী একজন।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2016, 03:18 PM
Updated : 26 July 2016, 05:35 PM

ওই ভবনের পেছনের একটি ভবনের ভাড়াটিয়া এক গবেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাজ মঞ্জিলের পেছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাত দেড়টার দিকে কয়েক যুবক খুব জোরে কথা বলছিল, মনে হচ্ছিল তাদের হাতে মাইক ছিল। তাদের কথা ছিল একদম স্পষ্ট।

“তারা নিজেদের আইএস সদস্য বলে পরিচয় দিচ্ছিল। তারা জিহাদ করছে বলেও দাবি করছিল। তাদের সঙ্গে ২০ জন সদস্য রয়েছে বলেও তারা বলছিল।”

মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের গার্লস হাই স্কুলের পাশে তাজ মঞ্জিল নামের ছয় তলা ওই ভবনে অভিযান চালায় পুলিশ, যার নাম পুলিশ দিয়েছে ‘অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স’।

‘জাহাজ বিল্ডিং’ নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত ওই ভবনের বেশিরভাগ ফ্ল্যাট মেস হিসেবে ভাড়া দেওয়া। ভবনের পঞ্চম তলায় জঙ্গিরা আস্তানা গেঁড়েছিল বলে পুলিশের তথ্য।  

রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘিরে ফেলার পর ভোরে সোয়াটের নেতৃত্বে এক ঘণ্টার অভিযানের পর ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নয়জন নিহত হওয়ার কথা জানায় পুলিশ।

অভিযানের পর পঞ্চম তলার ওই ফ্ল্যাটে অস্ত্র, বোমা ও জিহাদি বইয়ের পাশাপাশি কালো পতাকাও পাওয়া যায়। পুলিশের সরবরাহ করা ছবিতে দেখা যায়, নিহত সবার পরনে ছিল কালো পাঞ্জাবি, পাশে লাল-সাদা পাগড়ি।

এই পতাকা ওড়াতে এবং এমন পোশাক পরতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সদস্যদের দেখা যায়। গুলশান হামলাকারীদের যে ছবি আইএসের তরফে প্রকাশ হয়েছিল, তাদের পরনেও ছিল এই ধরনের পোশাক এবং পেছনে ছিল একই পতাকা।

তবে অন্য জঙ্গিদের মতো এদের আইএস সংশ্লিষ্টতার ধারণাও নাকচ করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক। সকালে অভিযান শেষে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “তারা নিজেদের আইএস বলে পরিচয় দিলেও তাদের সঙ্গে আইএসের কোনো ধরনের যোগসূত্র পাওয়া যায়নি।”

এই ভবনের পঞ্চম তলায় জঙ্গিরা আস্তানা গেঁড়েছিল

তার ধারণা, শেওড়াপাড়ার পর সন্ধান পাওয়া কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানাটিও নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবির সদস্যদেরই ছিল; এরা ও গুলশান হামলাকারীরা একই গোষ্ঠীভুক্ত বলেও মনে করেন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।   

মিরপুর থানার ওসি ভূইয়া মাহবুব হোসেন জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ চারদিক থেকে ঘেরাও করে ওই ভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে পাঁচতলার আস্তানা থেকে কয়েকজন জঙ্গি নেমে এসে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে।

এরপর পুলিশ পুরো বাড়িটি ঘেরাও করে রাখে যেন জঙ্গিরা পালিয়ে যেতে না পারে। তাদের আত্মসমর্পণ করতে মাইকে আহ্বান জানায় পুলিশ। সাড়া না পেয়ে ভোরে সোয়াটের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয়।

তাজ মঞ্জিলের বিপরীত দিকের মুকিত মঞ্জিল নামের ভবনের একটি ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জানালার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখেছিলেন পাঁচতলার বারান্দায় কালো পাঞ্জাবি গায়ে তিন জঙ্গিকে। তারা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে নানা কথা বলছিল, নিজেদের জিহাদি বলছিল।”

পুলিশের ছোড়া গুলিতে জঙ্গিদের কোনঠাসা হয়ে পড়ার মধ্যে এক তরুণ পাঁচতলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পাশের একটি স্কুলের ছাদে পড়েন। এরপর পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন তিনি।

ওই যুবকের নাম রাকিবুল হাসান বলে পরে জানা যায়। তিনি জঙ্গিদের ওই আস্তানায় বাবুর্চ্চির কাজ করতেন বলে দাবি করেছেন। বগুড়ায় তার বাড়ি থেকে এক বছর আগে পালিয়ে আসেন তিনি।   

ভবনের সিঁড়িতে পড়ে আছে গুলির খোসা

রাতের ঘটনার বর্ণনা করে মুকিত মঞ্জিলের ওই বাসিন্দা বলেন, “ওই সময় থেমে থেমে গুলিবিনিময় হচ্ছিল। ওরা একটা গুলি করলে পুলিশ গুলি করেছে ১০টা।”

তাজ মঞ্জিলের পাশের বাড়ির এক দারোয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই বিল্ডিং থেকে আল্লাহু আকবর, নারায়ে তকবির বলে ঘোষণা আসছিল। তারা আরবি-বাংলা মিলিয়ে আরও কি জানি বলছিল, বুঝতে পারি নাই।”

“ভোরে একটানা এক ঘণ্টার মতো গুলির শব্দ পাওয়া গিয়েছিল। ভয়ে গ্যারেজের ভেতর বসে ছিলাম। যদি গুলি লাগে, এই ভয়ে ছিলাম,” বলেন তিনি।

ভোরে চূড়ান্ত অভিযান শুরুর সময় জঙ্গিরা পালানোর চেষ্টা চালিয়েছিল জানিয়ে পুলিশ প্রধান শহীদুল বলেন, “তারা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গুলি করতে করতে পালানোর চেষ্টা করে। তাদের পরনে কালো রঙের জঙ্গি পোশাক ছিল, মাথায় ছিল পাগড়ি; সঙ্গে ছিল ব্যাকপ্যাক।”

জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া কলেমা লেখা কালো পতাকা

তখন পুলিশের গুলিতে নয়জনই প্রাণ হারান বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান। সাতজনের লাশ পাওয়া গেছে পঞ্চম তলার করিডোরে, দুজনের লাশ ছিল ওই তলার দুটি কক্ষে।

নিহতদের নাম-পরিচয় কিছুই জানা যায়নি।

ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, নিহতদের বয়স ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। তাদের কথাবার্তা শুনে এবং চেহারা ও বেশভূষা দেখে উচ্চশিক্ষিত বলে মনে হয়েছে।

“তাদের ওখানে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। সেগুলো আসল কি না, যাচাই করে দেখা হচ্ছে।”

লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। বুধবার সকালে তাদের ময়নাতদন্ত হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।