কল্যাণপুরে ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান,  নিহত ৯

রাজধানীর কল্যাণপুরে এক জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গোলাগুলিতে নয়জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2016, 00:48 AM
Updated : 26 July 2016, 00:48 AM

পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, ঘটনাস্থল থেকে একজনকে আটক করা হয়েছে। হতাহতরা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জেএমবির সদস্য বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন। 

কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের গার্লস হাই স্কুলের পাশে তাজ মঞ্জিল নামের ছয় তলা ওই ভবনকে স্থানীয়রা চেনেন ‘জাহাজ বাড়ি’ নামে, যেখানে বেশিরভাগ ফ্ল্যাট মেস হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ভবনের পঞ্চম তলায় জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছিল বলে পুলিশের তথ্য।  

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানান, সোমবার মধ্যরাতের পর পুলিশ ও র‌্যাবের প্রাথমিক অভিযান শুরু হয়। পরে সোয়াট বাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স’ নামে মূল অভিযান চলে ভোর ৫টা ৫১ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা।

অভিযানের পর মঙ্গলবার ভোরে সেখানে নয়জনের লাশ পাওয়া যায় বলে শেখ মারুফ হাসান জানান। তাৎক্ষণিকভাবে নিহত নয় জনের পরিচয় জানা না গেলেও ওই ভবন থেকে জিহাদি বই, বোমা ও অস্ত্র উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন তিনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরনে কালো পাঞ্জাবি ছিল। ওই বাসা থেকে আরও বেশ কিছু নতুন কালো পাঞ্জাবি ও কালো পতাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ওই ফ্ল্যাটে একটি গ্রেনেড ও একটি পিস্তল পাওয়া গেছে।”

গুলশানে জঙ্গি হামলার আগে পাঁচ জঙ্গি অস্ত্র হাতে কালো পাঞ্জাবি পড়ে আইএস এর কালো পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে, যা পরে আইএস প্রকাশ করে।

মিরপুর থানার ওসি ভূইয়া মাহবুব হোসেন জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে জঙ্গিবিরোধী ওই অভিযান শুরুর ঘণ্টা দেড়েক পর রাত ২টার দিকে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ডেকে ওই সড়কে আরও পুলিশ মোতায়েন করতে বলা হয়।

অভিযানের শুরুতে পুলিশ চারদিক থেকে ঘেরাও করে ওই ভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে পাঁচ তলার আস্তানা থেকে কয়েকজন জঙ্গি নেমে এসে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে বলে জানান ওসি। 

এ সময় পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির মধ্যে এক জঙ্গি আহত হয়। হাসান নামের ওই তরুণকে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ঢাকা মেডিকেলের নিবন্ধন খাতায় হাসানের বাবার নাম লেখা হয়েছে রেজাউল করিম। বাড়ি বগুড়ার জামিল নগরে। তার পায়ে গুলি, মাথায় জখমের চিহ্ন থাকার কথা নিবন্ধন খাতায় লেখা রয়েছে।

সকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আইজিপি বলেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ওই বাসায় তল্লাশি করেত গেলে পুলিশের দিকে গ্রেনেড ছোড়া হয়। সেখানে জঙ্গি আছে ধারণা করে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

“কিছু সময় পর পুলিশ পুরো বাসাটি কর্ডন করে ফেলে যেন জঙ্গিরা পালিয়ে যেতে না পারে। এরপর পুলিশের বিশেষায়িত টিম সোয়াট ও বোমা নিস্ত্রিয়করণ ইউনিট ঘটনাস্থলে যায় ও রেকি করে।

“ভোর ৫ টা ৫১ মিনিটে পুলিশ সেখানে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের সময় জঙ্গিরা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গুলি করতে করতে পালানোর চেষ্টা করে। তাদের পরনে কালো রঙের জঙ্গি পোশাক ছিল, মাথায় ছিল পাগড়ি; সঙ্গে ছিল ব্যাকপ্যাক।”

ব্যাগগুলো তল্লাশি করলে ‘নিশ্চয়ই কিছু পাওয়া যাবে’ বলে আইজিপি শহীদুল হকের ধারণা।

তিনি বলেন, “গুলশানে জেএমবির যে গ্রুপটি হামলা চালিয়েছিল, এরা সে গ্রুপেরই কেউ। আমাদের ধারণা তারা জেএমবির সদস্য, তবে ওরা নিজেদের আইএস বলে দাবি করে। আইএসের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।”

ওই ভবনের ছয় তলার বাসিন্দা আল্লামা ইকবাল অনিক জানান, ভবনের প্রতিটি তলায় চারটি করে ফ্ল্যাট। বেশিরভাগ ফ্ল্যাট ‘ব্যাচেলরদের’ ভাড়া দেওয়া, বাড়িওয়ালার পরিবার থাকে দোতলায়।  

মিরপুর থানার এস আই মিজানুর রহমান জানান, গত ২০ জুন সাতজন থাকার কথা বলে ওই বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। বাড়ির মালিকের নাম আতাহার উদ্দিন আহমেদ, তবে দেখভাল করেন তার আত্মীয়রা। পঞ্চম তলার ভাড়াটিয়াদের ব্যক্তিগত তথ্য তাদের হাতে নেই।

নিহতদের মধ্যে সাতজনের লাশ পাওয়া গেছে পঞ্চম তলার করিডোরে, দুজনের লাশ ছিল দুটি কক্ষে। 

সকালে ওই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায় পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে পুলিশ, দোকানপাট বন্ধ। ওই বাড়িতে কাউকে প্রবেশ করতে বা বের হতে দেওয়া হচ্ছে না।

কল্যাণপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক আকবর আলী জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা মঙ্গলবারের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা ও প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত করেছেন।

নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আশপাশের আরও কয়েকটি স্কুলে একদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

অতিরিক্ত উপ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোয়াটের অভিযান শেষে ওই ফ্ল্যাটে বিস্ফোরক আছে কি না তা খুঁজে দেখা হয়েছে। পরে ক্রাইম সিন ইউনিট তাদের কাজ করেছে।

সকাল ১০টার দিকে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলের কিছুটা দূরে সাংবাদিকদের বলেন, ওই জঙ্গি আস্তানায় বিস্ফোরক থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তল্লাশি শেষ করার আগে সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।

বিকাল ৫টার দিকে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নয়জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নেওয়া হয়। কল্যাণপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত কড়া পুলিশ পাহারায় অ্যাম্বুলেন্সগুলো যায়, কোনো সংবাদকর্মীকে কাছাকাছি বিড়তে দেয়নি পুলিশ।

নিহতদের ময়না তদন্ত কখন করা হবে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে পাওয়া যায়নি।

তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেছেন, বুধবার সকালে নয়টি লাশের ময়নাতদন্ত করবেন তারা।

“আমরা অজ্ঞাত পরিচয়ের হিসাবে লাশগুলো পুলিশের কাছ থেকে বুঝে পেয়েছিল। কাল সকাল ৯টায় ময়না তদন্ত শুরু করব,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।