গত শুক্রবার ১ জুলাই রাতে একদল অস্ত্রধারী তরুণ গুলশান ২ নম্বর সেকশনের ৭৯ নম্বর সড়কের ওই ক্যাফেতে হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ক্যাফের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়।
অভিযানে ১৩ জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়, ক্যাফের ভেতরে পাওয়া যায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনের রক্তাক্ত লাশ; যাদের নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানের ও একজন ভারতের।
নজিরবিহীন ওই ঘটনার পর থেকে পুরো এলাকা রয়েছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে; টহল দিচ্ছে র্যাব। সাঁজোয়া যানও দেখা গেছে গুলশান এলাকায়।
শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে দুই ঘণ্টা গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়ক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নীরব-নিস্তব্ধ হলি আর্টিজান বেকারি প্রাঙ্গণ। দোতলার বারান্দায় এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চেয়ার। মনে হচ্ছিল, কোনো ‘দানব’ সব কিছু উলট-পালট করে চলে গেছে।
জাপানের কয়েকজন সংবাদকর্মীও সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে একই ধরনের অনুভূতির কথা জানান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি এখনও অনুমতি পাইনি। তবে নিপ্পন টিভির কয়েকজন সাংবাদিক, যারা টোকিও থেকে এসেছেন, তারা মূল স্পটে গিয়ে ভিডিও করেছেন। তারা খুব কাছ থেকে সেদিনের ঘটনায় পড়ে থাকা জিনিসপত্রের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছেন।”
লেক পাড় থেকে দেখা গেল, হলি আর্টিজান বেকারির দোতলার বারান্দায় কাঠের গোলাকার টেবিল দুটির সাদা চেয়ারগুলো এলোমেলো পড়ে আছে। নিচতলার উত্তর পাশের কোণার পাঁচটি চেয়ারও এলোমেলা অবস্থায়। নিচতলার ভেতরটার কিছু অংশ কাচের জানালা দিয়ে দেখা গেলেও সব মিলে যেন ‘ভূতের বাড়ি’ মনে হচ্ছিল হলি আর্টিজান বেকারিকে।
বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় এই বেকারির সবুজ ঘাসে থাকা কাঠের সাদা চেয়ারে বসেও আলাপচারিতার পাশাপাশি খাবার খেতেন বিদেশিরা। যেখানে শুক্রবারের হামলার পর নেই কোনো প্রাণচাঞ্চল্য।
বারিধারা-গুলশানের লেকের পশ্চিম প্রান্তকে গুলশান লেক ও পূর্ব প্রান্তকে বলা হয় বারিধারা লেক।
বারিধারার জাতিসংঘ সড়ক থেকে দেখা যায় হলি আর্টিজান বেকারি। সেখানকার ৬ নম্বর ভবনের বাসিন্দা প্রকৌশলী মনিরুল হাসান বখত বলেন, “এক সপ্তাহ আগে ঠিক ফ্রাইডে আফটারনুনে ওই ক্যাফের সুবজ প্রাঙ্গণে ১২/১৩ জন বিদেশিকে বসে থাকতে দেখেছি। ... আজ দেখছি একেবারে বিরানভূমি।
“সন্ত্রাসীরা যেভাবে নিরপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, ওদের কি বিনাশ হবে না? স্যাড। আমরা কিছুই করতে পারিনি বন্ধু ও বিদেশিদের জন্য।”
গত সপ্তাহের ওই ঘটনার প্রভাবে ঈদে আনন্দ হয়নি জানিয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, “পরিবারের সদস্যরা কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছে। কেবল তাই নয়, আপনি দেখবেন, বারিধারা ও গুলশান লেকের কাছাকাছি এলাকায় বসবাসরত কোনো মানুষের মনেই আনন্দ নেই। গত ঈদে এসব সড়কে অনেক গাড়ির চলাচল ছিল; এবার কিন্তু তেমন চলেনি।”
তাদের একজন ইতালির নারী মারিয়া জোলি; যার পুষ্পস্তবকে লেখা ছিল- “ফরগিভ আস ফ্রেন্ড, উই আর ...।”
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সেখানে কথা হয় রজনীগন্ধার তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাকসুদা নামে গুলশানের এক বাসিন্দার সঙ্গে। ব্যারিকেডের সামনে তোড়াটি রেখে বেশ কিছু সময় মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান তিনি। মনে হচ্ছিল, নীরব শোকের রোমন্থন করছেন তিনি।
জাপানের এনএইচকে টিভির সাংবাদিকদের প্রশ্নে নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা প্রবীণ এক স্কুল শিক্ষিকা বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এরকম হিংস্রতা নেই। যেভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, ওরা ইসলাম ধর্মের লোক নয়, মুখোশধারী, ওরা জঙ্গি।”
জাপানি দুই সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গুলশানের ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে দেশটি থেকে ৭০ জন সাংবাদিক ঢাকায় এসেছেন। তাদের মধ্যে টেলিভিশন ও জাতীয় দৈনিকের কর্মীরা আছেন।
আসাহি শিম্বুন পত্রিকার সাংবাদিক তাকাহারু ইয়াজি ক্যাফেতে জঙ্গি হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “এটা বেদনা ও বিষাদের। উগ্রপন্থিরা এটা করেছে বলে আমরা মনে হচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্কে ছেদ ধরাতে এটা করা হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।”