গুলশান হামলা: সেনা অভিযানের আগে দুই দফা বিফল হয় পুলিশ

গুলশানের ক্যাফেতে সন্ত্রাসীরা অবস্থান নেওয়ার পর দুই দফা অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল পুলিশ-র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2016, 06:19 PM
Updated : 31 July 2016, 07:25 PM

ওই অভিযানে প্রায় দেড়শ রাউন্ড গুলি ছোড়া হলেও কোনো জঙ্গি তাতে ঘায়েল হয়নি; বরং প্রাণ দিতে হয়েছে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে, আহত হয়েছেন ৩০ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৩২ জন।

জুলাইয়ের প্রথম দিন কূটনৈতিকপাড়ার আপাত নিশ্ছিদ্র নিরপত্তার মধ্যে নজিরবিহীন সেই জঙ্গি হামলার ঘটনায় গুলশান থানায় যে মামলা পুলিশ দায়ের করেছে, তার এজাহারে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

মামলার বাদী গুলশান থানার উপ পরিদর্শক রিপন কুমার দাস এজাহারে লিখেছেন, সেদিন রাত পৌনে ৯টার দিকে হামলার খবর পেয়ে ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে’ পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখতে পায়, হলি আর্টিজান বেকারির ভেতর ‘কতিপয় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আল্লাহ আকবর ধ্বনি দিয়ে’ এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমাবর্ষণ করছে।

বেকারির ভেতরে লোকজন ‘দিগ্বিদিক ছোটোছুটি করছিল সে সময়। অস্ত্রধারীরা পুলিশ দেখে ‘গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি’ করলে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য এরপর সেখানে যান এবং উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলে।

ওই সময় প্রথম আহত হন গুলশান থানার উপ পরিদর্শক ফারুক হোসেন।

এরপর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ দুই বাহিনীর ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা তাদের সদস্যদের নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং অভিজাত এলাকার ভেতরে গুলশান লেকের পাশের ওই ক্যাফে ঘিরে ফেলেন।

এজাহারের বিবরণ অনুযায়ী, তারা জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য আবারও চেষ্টা শুরু করলে সন্ত্রাসীরা ফের গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। কিন্তু সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া হামলায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরই মধ্যে পুলিশ সদস্যসহ ৩২ জন আহত হন।

আহতদের মধ্যে অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মো. মারুফ হাসান, অতিরিক্ত উপ কমিশনার আবদুল আহাদ ও ওবায়দুল হক, গুলশান থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম, পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান, পেট্রোল ইন্সপেক্টর রফিকুল ইসলাম, উপ পরিদর্শক ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস, রাকিবুল ইসলাম খান, সুজন কুমার, মাহাবুব আলম, ইয়াসিন গাজী, ফারুক হোসেন, কবির হোসেন ও শেখ খালিদুর রহমান ছিলেন।

আরও ছিলেন সহকারী উপরিদর্শক নুরজ্জামান, বিল্লাল ভূইয়া, মতিউর রহমান ও নূর ইসলাম; নায়েক আক্তারুজ্জামান; কনস্টেবল মাসুদ রানা, মানিক মিয়া, সোহাগ খান, জাকির হোসেন, কামরুজ্জামান, সজীব মিয়া, আনারুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, প্রদীপ চন্দ্র দাস ও মাহফুজুর রহমান। 

এছাড়া ব্যাটালিয়ান আনসার মেজবাউল শেখ, পুলিশের রিকুইজিশন করা গাড়ির চালক রাজ্জাক ও জিয়াউর রহমানও আহত হন। তাদের সবাইকে উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়।

এর মধ্যে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ খান ১১টা ২০ মিনিটে মারা যান। বিছুক্ষণ পর একই হাসপাতালে মারা যান সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম।

এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় পুলিশ পিস্তলের ২৫ রাউন্ড, চাইনিজ রাইফেলের ৪ রাউন্ড, এসএমজির ১২ রাউন্ড ও শটগানের ১১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে বলেও হিসাব দিয়েছেন বাদী।

ওই দুই অভিযানে ব্যর্থ হয়ে ক্যাফে থেকে কিছুটা দূরে ৭৯ নম্বর রোডের মোড়ে অবস্থান নেয় পুলিশ। এরপর তারা আর ক্যাফেতে ঢোকার চেষ্টা করেনি।

পরদিন সকাল পৌনে ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল জিম্মিদের উদ্ধারে অভিযানে নামে। সে সময় হ্যান্ড মাইকে পুলিশকে গুলি ছুড়তে নিষেধ করা হয়।

এজাহারে বলা হয়, সেনাবহিনীর অভিযানের সময়ও সন্ত্রাসীরা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় এবং গুলি চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির পর ‘কমান্ডোরা সফল হন’ এবং তারা দেশি-বিদেশি মোট ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হন।

অবশ্য কমান্ডো অভিযানের আগেই রাতে পুলিশ ক্যাফের আশপাশ থেকে দুই বিদেশিসহ মোট ১৯ জনকে উদ্ধার করে বলে এজাহারের ভাষ্য। 

অভিযান শেষে হলি বেকারি থেকে দেশি-বিদেশি ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া হামলাকারী ছয়জনের লাশ উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে এজাহারে, যে সংখ্যা এর আগে সেনা সদরদপ্তর থেকেও বলা হয়েছিল।