নিজেকে একজন ‘ব্যর্থ পিতা’ হিসেবে বর্ণনা করে ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা মঙ্গলবার বলেন, “এটা খুবই দুঃখজনক, কষ্টকর এবং বিব্রতকর। ফেইসবুক ও টিভিতে জানতে পারলাম, যে আমার ছেলে জড়িত। আমি একজন ব্যর্থ পিতা। আমি আপনাদের মাধ্যমে সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
বাবুল বলেন, “ক্লাস নাইনে থাকতে যে ছেলে তেলাপোকা মারতে পারত না, সেই ছেলের হাতে এতবড় অস্ত্র! এসব অস্ত্র কোথা থেকে আসে? তাদের কারা ট্রেনিং দেয়, অর্থদাতা কে? তাদের খুঁজে বের করতে আমি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাই।”
ইমতিয়াজ বাবুল সদ্য বিলুপ্ত অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উপ-মহাসচিবের দায়িত্ব ছাড়াও বাংলাদেশ সাইক্লিস্ট ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি পদে আছেন তিনি।
তবে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর কমান্ডো অভিযানে নিহত যে পাঁচজনের ছবি পুলিশ গত শনিবার ‘হামলাকারী’ হিসেবে প্রকাশ করেছিল, সেখানে রোহান নেই বলে তার স্বজনরা সে সময় জানিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার বাবা ইমতিয়াজ বাবুল মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোহানের মৃতদেহ সিএমএইচে আছে বলে আমাদের জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। লাশ কবে দেওয়া হবে সে ব্যাপারে কিছু বলেনি।”
এ ব্যাপারে রোহানের পরিবারের এক আত্মীয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জানতে পেরেছি, মুখমণ্ডল বিকৃত হওয়ায় ছবি প্রকাশ করা হয়নি।”
শুক্রবার বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম ওই জঙ্গি হামলার ঘটনায় বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় ওই বেকারিতে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে রোহানের মত তরুণ পাঁচ উগ্রপন্থি।
জিডিতে বলা হয়, গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক ভারতে যান ইমতিয়াজ বাবুল। ভারতে থাকার সময় ৩০ ডিসেম্বর রোহান বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি বলে খবর পান তিনি।
১ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আত্মীয়-স্বজন ও রোহানের বন্ধু-বান্ধবের কাছে সন্ধান করেও খোঁজ না পেয়ে ৪ জানুয়ারি জিডি করেন তিনি।
মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ অনেকের সন্তান রোহানের মত নিখোঁজ আছে বলে তার কাছে তথ্য আছে। অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগও আছে।
“আমার সন্তান যেভাবে নিখোঁজ হয়েছে, তাদের নিখোঁজ হওয়ার ধরনটাও একই রকম। তাদের পরিবারও সন্তান খুঁজে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা দিচ্ছেন। কিন্তু তারা মিডিয়ার সামনে আসছেন না, ছবি প্রকাশ করছেন না। সন্তানকে মেরে ফেলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় তারা সামনে আসছে না।”
ইমতিয়াজ বাবুল বলেন, এমন একজন বাবা তার ছেলের সন্ধান দিতে পারলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ওই বিজ্ঞাপন দিলে তার সন্তানকে মেরে ফেলা হতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা কেউ কেউ বললে বিজ্ঞাপন দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরে আসেন।
‘নিখোঁজ’ সেই তরুণদের সংখ্যা জানতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন ইমতিয়াজ বাবুল।
তিনি বলেন, “আমার পরিবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। আমার বাসায় সবসময় মুক্তিযুদ্ধ,স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু নিয়ে কথা হয়। সেখানে আমার সন্তান মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কীভাবে এতবড় ঘটনায় জড়িয়ে গেল তা খুঁজে বের করা দরকার।”
বাবার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী,নানার সংস্পর্শে রোহান পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই নামাজ পড়া শুরু করেন। দুই বোন ছাড়া স্বল্পভাষী রোহানের খুব ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু ছিল বলেও পরিবারের সদস্যরা জানেন না।
স্কুলে এবং এ লেভেলে পড়ার সময় রোহান মায়ের সঙ্গে একই গাড়িতে করে আসা-যাওয়া করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর একা চলাফেরা করলেও সেমিস্টার ফি দিতে নিজে একবার গিয়েছিলেন বলে জানান ইমতিয়াজ বাবুল জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, রোহান কখনো দেশের বাইরে যায়নি। তবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস করলে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে এমবিএ পড়ানোর ইচ্ছা ছিল।
ইমতিয়াজ বাবুল বলেন, তার বাসায় একটিই টিভি, ছেলেমেয়েদের একটিই কম্পিউটার। রোহানের ঘরে আলাদা কোনো কম্পিউটার নেই; তবে সে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকতে পারে।
রোহানের ঘরও ঘুরে দেখান তার বাবা। সেখানে হুমায়ুন আহমেদের কিছু বই ও ইংরেজি সিনেমার কয়েকটি ডিভিডি দেখা যায়।
প্রথম জীবনে শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ইমতিয়াজ খান বাবুল বলেন, “আমার ছাত্ররা আজ বড়বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। দেশ চালাচ্ছে। অথচ আমার ছেলের আজ এই অবস্থা। এটা বড় লজ্জার।
“এজন্য আমি অভিভাবকদের বলব, আরও বেশি করে সন্তানদের প্রতি যত্নবান হোন, বড় হলেও সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখুন।”
রোহানের মা ঘটনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি জানিয়ে তিনি বলেন, “আর যেন কোনো পিতাকে এমন অবস্থার শিকার হতে না হয়।”
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সালাহউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম ও সাজিদুল হক।]