নিহত ৯ ইতালীয়র সাতজনই গার্মেন্ট ব্যবসায়ী

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ইতালির নয়জন নাগরিকের সাতজনই গার্মেন্ট ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে  অন্তঃসত্ত্বা এক নারীও ছিলেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2016, 09:20 AM
Updated : 4 July 2016, 09:58 AM

শনিবার কমান্ডো অভিযানে ওই ক্যাফের জিম্মি সঙ্কটের অবসানের পর ইতালির ‘কোরিয়ে দে লা সেরা’ ও ‘লা রিপাবলিকা’ নিহত ইতালিয়ানদের পরিচয় প্রকাশ করে।

গত শুক্রবার রাতে গুলশান ২ নম্বরের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় একদল অস্ত্রধারী জঙ্গি; দেশি বিদেশি অন্তত ৩৩ জন সেখানে জিম্মি হন।

প্রায় ১২ ঘণ্টা পর কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওই রেস্তোরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্রবাহিনী। ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ২০ জনের লাশ পাওয়া যায় জবাই করা অবস্থায়।

নিহত নয়জন ইতালিয় হলেন- নাদিয়া বেনেদিত্তো, ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো, ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা, সিমোনা মন্টি, মারিয়া রিবোলি, আডেলে পুগলিসি, ক্লদিও চাপেলি, ক্রিস্টিয়ান রোসিস ও মারকো তোনডাট।

এদের মধ্যে ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো এবং মারিয়া রিবোলি বাদে বাকিরা তৈরি পোশাক শিল্পে জড়িত ছিলেন।

নিহতদের পরিচয় তুলে ধরা হলো-

নাদিয়া বেনেদিত্তো, ৫২

ইতালির ক্যাসিয়ার বাসিন্দা নাদিয়া ছিলেন স্টুডিও টেক্স লিমিটেড নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তার ওই প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে ১৮শ’ কর্মী কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর লন্ডনে, বাংলাদেশে এর একটি শাখা অফিস আছে।

নাদিয়ার ভাতিজি গিলিয়া বেনেদিত্তো জানিয়েছেন, তার ফুফু নিজ দেশ ছাড়াও কেনিয়াতেও কাজ করেছেন।

ক্যারিয়ারে দুর্দান্ত সফল এ নারী বন্ধু ও স্বজনদের কাছে আমুদে মানুষ, শখের গায়ক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।

ফেইসবুকে ফুফুর মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে গিলিয়া বলেন, “এখন আমরা আমাদের শেষ আশাও হারিয়ে ফেলেছি। আমার ফুফু নাদিয়া বেনেদেত্তি গতকাল (১ জুলাই) বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। আমরা একে অপরকে আর দেখতে পাব না, আমাদের কথা হবে না, ফ্যাশন নিয়ে আর কোনো কথা হবে না, আমরা আর কখনই একসঙ্গে গান গাইতে যাব না।”

নৃশংস ওই হামলার কথা স্মরণে রাখার আহ্বান জানিয়ে গিলিয়া লিখেছেন, “আমি বন্ধু, আত্মীয় এবং অন্যদের অনুরোধ করব- তাকে ভুলে যেও না, তার স্মৃতি হারিয়ে ফেল না। কি হয়েছিল কখনই ভুলো না, ওই সব উগ্র মানুষের আরও ধ্বংসলীলা চালাতে দিও না, তাদের জিততে দিও না।

“আমি ওই ঘটনায় নিহত-আহত সবার প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। ফুফু আমরা তোমাকে সবসময় মিস করব।” 

ক্লদিও চাপেলি, ৪৫

ইতালির মনজা শহরের ভেদানো এল ল্যামব্রো এলাকার বাসিন্দা ক্লদিও চাপেলি বাংলাদেশের একটি পোশাক কারখানায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করছিলেন। ওই কারখানায় টি-শার্ট, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক তৈরি হয়।

নিহত এই ইতালিয়ান বাংলাদেশে তার কাজ উপভোগ করছিলেন বলে বন্ধুরা জানিয়েছেন।

তার বন্ধু ও ভেনোতোয় বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল জিয়ানালবার্তো স্কার্পা বাস্তেরি বলেন, “সে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে খুশি ছিল, বাংলাদেশে তার অভিজ্ঞতা ছিল চমৎকার। বলেছিল এটা একটা চমৎকার দেশ, যেখানে তুমি ভালোভাবে কাজ করতে পারো।”

সব সময় কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা গুলশানে এ ধরনের হামলায় বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন তিনি।

“আমি বুঝতে পারছি না এই হামলা কীভাবে হলো। গুলশানে অনেকগুলোর দেশের দূতাবাস আছে, আছে বড় বড় কোম্পানির অফিস, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের তল্লাশি এবং ভালো নিরাপত্তা। তুলনামূলকভাবে ওই এলাকা হচ্ছে দেশটির অন্যতম নিরাপদ স্থান। সেখানে এ ধরনের হামলায় আমি বিস্মিত হয়েছি।”

ভাই ক্লদিওর মৃত্যুতে শোকে কাতর তার বোন বলেন, “এটা আমাদের জন্য শোকাবহ একটি ঘটনা। হতবাক করা এ হত্যাকাণ্ডে আমরা স্তম্ভিত; এরকম হতে পারে আমরা ভাবতেও পারিনি।”

ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো, ৪৬

ইতালির ক্যাসেরতা শহরের পাইদিমন্তে মাতেসি এলাকার বাসিন্দা ভিনসেনজো বাংলাদেশে কি কাজ করতেন তা জানা যায়নি।

গত বছরের অক্টোবরে নেপলসে বসত গড়া এই ইতালিয়ানের জন্ম অবশ্য সুইজারল্যান্ডের ওয়েটজিকন শহরে। ইতালির গ্লসপ শহরের মেয়ে মারিয়ার সঙ্গে ১৯৯৩ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা, ৫৬
২০ বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করা ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা ছিলেন তার দেশি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান ফেডো ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। গতবছরই বিয়ে করেছিলেন স্বদেশি জিয়ান গ্যালেজ্জো বচেত্তিকে।

বচেত্তি নিজেও ওইদিন সন্ধ্যায় হলি আর্টিজানে স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন; ফোনে কথা বলতে ক্যাফের লনে আসামাত্রই তিনি দেখতে পান বন্দুকধারীরা ক্যাফেতে ঢুকে এলাপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছে, এরপরই পালিয়ে প্রাণ বাঁচান তিনি, কিন্তু হারিয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে।

“অনেক ঘণ্টা ধরে আমি অলৌকিক কিছুর প্রত্যাশা করছিলাম; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যকে মেনে নিতে হচ্ছে। মারিয়া মারা গেছে, খুব সম্ভবত তাকে কষ্ট করতে হয়নি, হয়তো একটি বুলেট তাকে মুহূর্তের মধ্যে নিস্তেজ করে ফেলেছিল,” বলেন বিধ্বস্ত বচেত্তি।  

তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক মারিয়া নিরাপত্তা, দারিদ্র্য ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘গ্রিন ক্রস’ এবং মানবতাবাদী ‘ইন্তারেথনস ইন্টারপ্লাস্ট ইতালি অনলুসের’ স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন।

প্রতিবছরই তিনি ঢাকায় ইতালি থেকে ১৫-২০ জন স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসককে নিয়ে আসতেন। তারা দরিদ্র নারীদের চিকিৎসা দিতেন বলে জানিয়েছেন বচেত্তি।

২০১৫ সালে ভারতের চেন্নাইতে ফেডো ট্রেডিং লিমিটেডের একটি শাখা খোলেন মারিয়া, সেখানেই হতে চেয়েছিলেন থিতু। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে স্বামীর সঙ্গে থাকতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

আডেলে পুগলিসি, ৫০

কাতানিয়ার বাসিন্দা আডেলে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানা ‘আর্টসানা’য় মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপক ছিলেন। শনিবারই তার দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। আডেলে এর আগে নাদিয়ার স্টুডিও টেক্স লিমিটেডেও কাজ করেছেন।

সিমোনা মন্টি, ৩৩

ইতালির রাজধানী রোমের কাছাকাছি শহর ম্যাগলিয়ানো সবিনোতে বসবাস করতেন সিমোনা মন্টি। বাংলাদেশে দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পোশাক কারখানায় কর্মরত এ নারী।

গুলশানে শুক্রবার জঙ্গিরা সাত মাসের এ অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও রেহাই দেয়নি। অনাগত সন্তানটি ছেলে ছিল বলে জানিয়েছে কোরিয়ে দে লা সেরা।

সিমোনার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় তার যাজক ভাই লুকা মন্টি আশা প্রকাশ করেছেন, বোনের এই জীবনদানের ঘটনা বিশ্বে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে।

মারকো তোনডাট

তরুণ এ ব্যবসায়ী ছিলেন ইতালির কর্দোভাদো এলাকার বাসিন্দা, তিনিও স্টুডিও টেক্স লিমিটেডে কাজ করতেন। মারকোর ছয় বছর বয়সী এক মেয়ে আছে বলে লা রিপাবলিক জানিয়েছে।

ক্রিস্টিয়ান রোসিস, ৪৭

ফেলেত্তো আমবার্তো (ইউদিন) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী

ক্রিস্টিয়ান রোসিস। তিন বছর বয়সী যমজ কন্যার এ জনকের বৃহস্পতিবার দেশে ফেরার কথা ছিল, কিন্তু পরে বাড়ি ফেরা কয়েকদিনের জন্য পিছিয়ে দিয়েছিলেন।

ফাইবার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ছিলেন  রোসিস। তৈরি পোশাক শিল্পের পরামর্শক ও ব্রোকারেজ এ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ও চীনে কাজ করে।

মারিয়া রিবোলি, ৩৩

ইতালির লোম্বার্ডে জন্ম নেওয়া রিবোলি থাকতেন সোলজা এলাকায়। স্বামী ও তিন বছর বয়সী মেয়েকে রেখে ব্যবসায়িক কাজে কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন, কাজ করতেন তৈরি পোশাক খাতে।

নিহত নয়জনের মধ্যে পাঁচজন ইতালিয়ান পরষ্পরের পচিরিত ছিলেন বলে ধারণা করছে কোরিয়ে দে লা সেরা। তারা নিয়মিতই হলি আর্টিজান বেকারিতে যেতেন। যে টেবিলে তারা একসঙ্গে বসে ছিলেন জঙ্গিরা এসেই তার নিচে একটি গ্রেনেড ছোড়ে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি জানিয়েছে।

শুক্রবারের হামলায় হলি আর্টিজানের এক ইতালিয়ান পাচক ছাদ টপকে পালাতে সক্ষম হন বলে কোরিয়ে দে লা সেরার প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

নিহতদের মধ্যে রয়েছেন সাতজন জাপানি ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি, যাদের মধ্যে একজনের যুক্তরাষ্ট্রেরও নাগরিকত্ব ছিল।

রেস্তোরাঁয় হামলার পরপরই সেখানে আটকেপড়াদের উদ্ধারে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দীন হামলাকারীদের বোমার স্প্লিন্টারে নিহত হন।