সুনসান হলি আর্টিজান

গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রাস্তার শেষ অংশে এখন সব শান্ত; গত দুই দিনে সেখানে ঘটে গেছে নজিরবিহীন সব ঘটনা।

শরীফ উল্লাহ বাবুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2016, 09:53 AM
Updated : 31 July 2016, 07:05 PM

জঙ্গি হামলা ও পরে কমান্ডো অপারেশন থান্ডার বোল্টে প্রায় বিধ্বস্ত হলি আর্টিজান বেকারির সামনে রোববার সকালে কেবল কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে পাহারায় দেখা গেল।

আশপাশের বাসিন্দারা এখনও ধাতস্থ হতে পারেননি। অতি শান্ত পরিবেশেও যেন শান্তির অভাব। উদ্বেগের ঘোর আর নিরাপত্তার কড়াকড়িতে এখনও হয়তো নিরাপদ বোধ করতে পারছেন না তারা।

রাস্তার শেষ প্রান্তে লেকের পাশে হলি বেকারি দুই দিন আগেও ছিল প্রাণোচ্ছ্বল মানুষের আনাগোনায় সরব। গুলশান এলাকার বিদেশিদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় ওই ক্যাফে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও কাছেও ছিল পছন্দের গন্তব্য।

ওভেন থেকে বের করা গরম রুটি আর বেকারির খাবারের জন্য সকালেই সেখানে হাজির হতেন অনেকে। বিকেলে সবুজ লনে চলতো আড্ডা।

পোষা প্রাণিদের প্রবেশাধিকার থাকায় অনেকেই শখের প্রাণিটিকে সঙ্গে করে নিয়ে বেকারিতে আসতেন। সবুজ মাঠে খেলত শিশুরাও; সেখানে এখন ছড়িয়ে আছে ধ্বংসস্তূপ আর সাঁজোয়া যানের চাকার দাগ।

বেকারির বাইরের অংশে লেক ভিউ ক্লিনিকের পার্কিংয়ে এখনও রাখা পাঁচটি গাড়ি। এর একটি দুমড়ে মুচড়ে গেছে অভিযানের সময় সাঁজোয়া যানের চাকার নিচে পড়ে।

বাকি গাড়ির মালিকদের খবর নেই, দুইদিন ধরে সেগুলো পড়ে আছে সেখানে। পার্কিং এলাকার লোহার ফটক বন্ধ করে ভেতরে-বাইরে পাহারায় পুলিশ। লেকের ওয়াকওয়েতেও পুলিশের পায়চারি।

৭৯ নম্বর রোডের অবরুদ্ধ অংশটুকুতে আছে ২০ কাঠার ১০টি প্লট। এর মধ্যে সাতটিতে রয়েছে বহুতল ভবন, একটিতে নতুন ভবন ওঠার অপেক্ষা।

বাকি দুটি প্লটের একটিতে লেকের পারে দারুণ লোকেশনে হলি আর্টিজান বেকারি; আর বিপরীত দিকের অন্য প্লটে লেক ভিউ ক্লিনিক।

শুক্রবার রাত আর শনিবার দুপুর পর্যন্ত আতঙ্কে থাকা এলাকাবাসী রোববার একটু হাঁফ ছাড়তে পারলেও দুঃসহ ১২টি ঘণ্টা তাদের তাড়িয়ে ফিরছে। বারান্দা থেকে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ছে ধ্বংসস্তূপ।

অভিযানের পর বিপদ কেটে গেলেও অনেকেই আর শনিবার ঘর থেকে বের হননি। রোববার নানা প্রয়োজনে আবার তাদের বের হতে হচ্ছে। কিন্তু রাস্তার মাথায় পুলিশ ব্যারিকেডে পড়তে হচ্ছে নানা প্রশ্নের মুখে।

৭৯ নম্বর রোড যেখানে ৭৫ নম্বর রোডে মিলেছে, সেখানে রয়েছে একটি ব্যারিকেড। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সতর্ক পাহারায় পুলিশ সদস্যরা। আছেন দুইজন নারী পুলিশও। কয়েক দফা প্রশ্ন ও শরীর তল্লাশির পর ভেতর থেকে ব্যারিকেড পার হয়ে বাইরে যাওয়া সম্ভব।

তবে উল্টো পথে ব্যারিকেড পার হয়ে ভেতরে আসা আরও কঠিন। এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা কেবল ঢুকতে পারছেন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিয়ে। আর যারা আসতে চাইছেন, তাদের পরিচিত কাউকে বাসা থেকে গিয়ে পরিচয় দিয়ে এগিয়ে আনতে হচ্ছে।

শনিবার অভিযান শেষে যৌথবাহিনী চলে যাওয়ার পর ওই রাস্তায় যাওয়ার সাহস করেননি অনেকেই। বিভিন্ন বাসায় যারা রাঁধুনি, গৃহকর্মী বা মালির কাজ করেন, তারাও রোববার সকালে কাজে এসে এই বিপত্তিতে পড়েন।

একটি অ্যাপার্টমেন্টে রাঁধুনির কাজ করা অনিমা চিশিম জানালেন, যার বাসায় কাজ করেন তিনি ব্যারিকেডে গিয়ে তার জিম্মায় তাকে ভেতরে ঢুকিয়েছেন।

হলি আর্টিজানের ঠিক পাশের ভবনের একটি ফ্ল্যাটের মালিককে ব্যারিকেড পার হয়ে ভেতরে ঢুকতে বেশ ঝক্কি পেতে হয়। তার ভাড়াটিয়ারা বিদেশি নাগরিক।

শনিবারের অভিযানের সময় গোলাগুলিতে বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে গেছে। তিনি এসেছেন মেরামতের ব্যবস্থা করতে।

কিন্তু পুলিশ সদস্যদের পরামর্শ, এখন না করে ঈদের পরে কাজ করাতে হবে।

ফ্ল্যাট মালিক তাদের উত্তর দেন, “বৃষ্টিতে ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে পানি ঢুকছে, জানেন আমার ফ্ল্যাটের দাম কত?”

শেষ পর্যন্ত অনেক তর্কের পর ব্যারিকেড পার হতে পারেন ওই ভদ্রলোক।

এক নারী বাসিন্দা বেরুতে গিয়ে ব্যারিকেডে আটকা পড়েন; পুলিশের জেরার মুখে জানান, সামনে ঈদ, বাজার তো করতে হবে।

ওই গৃহিনীর দাবি, বিধিনিষেধের কথা জানিয়ে একটি নোটিস দেওয়া উচিত ছিল এলাকার বাসিন্দাদের। সামনে ঈদ; অনেক অতিথির আসা-যাওয়ার কথা।

ব্যারিকেডে এক জনের কার্টন খুলে ভেতরের আম দেখাতে হল। পুলিশ সদস্যরা বলেছিলেন, সব আম মাটিতে ঢালতে। আমের মালিক সেই নারী তখন প্রশ্ন করলেন, সব আম মাটিতে ঢাললে আবার উঠাবেন কীভাবে?

আরও অনেককে দেখা গেল চাল-ডাল নিয়ে বাসায় ফিরছেন হেঁটে। দুপুরের আগে একটি গাড়ি বের হলো; তবে আগাপাশতলা পরীক্ষা করার পর।

ভেতরে ঢোকা আরেকটি গাড়ির চালক জানালেন, গাড়ি ঢোকানো গেছে অনেক ঝক্কির পর। এই চেষ্টা না করাই ভালো।

খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ বাসার বাইরে যাচ্ছেন না। তবে ঈদে যারা বাড়ি ফিরবেন, তাদের না বেরিয়ে উপায় নেই।

একটি পরিবারের সদস্যদের দেখা গেল বাক্স-পেটরা নিয়ে রওনা দিতে। ব্যারিকেডে সব সুটকেস খুলে পরীক্ষার পর তাদের যেতে দেওয়া হল।

বেকারি থেকে একটু দূরের একটি ভবনের ছাদে পোষা কুকুর নিয়ে পায়চারি করছিলেন এক তরুণী। জানালেন, প্রতিদিন সকালে কুকুর নিয়ে বাইরে যান, আজ সাহস হয়নি।

যে বেকারিকে ঘিরে গত দুই দিনে এত নাটকীয়তা, যেখানে পুরো স্তব্ধতা।

লেকের ওয়াকওয়েতে সাধারণের চলাচল বন্ধ। পাশের দশতলা ভবনটির আড়াই লাখ টাকা থেকে শুরু বিভিন্ন ভাড়ার ফ্ল্যাটগুলোর বেশিরভাগই খালি। সেটার মূল ফটকের বাইরেও পুলিশ আছে।

শুক্রবার রাতে ওখানেই বোমার স্প্লিন্টারে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন পুলিশের এক কর্মকর্তা। বৃষ্টি হওয়ার পরও রক্তের দাগ রয়ে গেছে; কেউ ধুয়ে ফেলারও সাহস করছেন না।

পুলিশের সদস্যদের পাহারা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, সেই সঙ্গে তদন্তের দেখভাল করতে উপরের স্তরের পুলিশ কর্মকর্তারা আসছেন মাঝেমধ্যে। বেকারির গেইটে থাকা দুই পুলিশ সদস্য একটু আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে খেতে হল বকা।

তাদের বলা হল, বন্দুক কাঁধে নিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, কারণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি এখন গুলশানে। কিছুক্ষণ পর আরেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তার নির্দেশে কড়া রোদেও তাদের পরতে হলো হেলমেট; বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আগেই পরা ছিল।

ব্যারিকেডে শরীরের প্রতিটি অংশ তল্লাশি করার সময় একজন বললেন, “হামলার আগে যদি এমন তল্লাশি করতেন...”।

দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের জবাব, “আমাদের কাজ আমরা করছি। এটা আমাদের দায়িত্ব।”

কূটনীতিক পাড়ার এরকম সুরক্ষিত একটি অংশে এমন হামলা চালানো সম্ভব- তা কল্পনাও করতে পারেননি এলাকার বাসিন্দারা।

স্থানীয় ক্যাফে-রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে হলি আর্টিজান বেকারিতে বিদেশিদের আনাগোনা ছিল বেশি। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেগুলোতে পুরো প্রাঙ্গণ ভরা থাকত। সবুজ লনে চাদর বিছিয়ে রোদও পোহাতেন অনেকে, ঢাকায় যে দৃশ্য প্রায় বিরল।

কিন্তু আগে কখনো নিরাপত্তার এতো কড়াকড়ি চোখে পড়েনি বলে স্থানীয়রা জানালেন। তারা বলছেন, গুলশান ২ নম্বর মোড় থেকে সতর্ক পাহারায় থাকা বিভিন্ন দূতাবাসের পাশ দিয়েই আসতে হতো বলে ৭৯ নম্বর রোডের নিরাপত্তায় হয়ত ফাঁক থেকে গিয়েছিল।