প্রাণঘাতী ইউপি নির্বাচনের শেষ ভোটগ্রহণ

অনিয়ম, সহিংসতায় প্রাণহানির মধ্য দিয়ে চলে আসা নবম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের শেষ পর্বের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2016, 05:57 PM
Updated : 4 June 2016, 10:32 AM

সুষ্ঠুভাবে এ পর্বের ৬৯৮ ইউপিতে শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) আশা ছিল, শেষ ধাপের এই ভোট আগের তুলনায় ‘ভালো করার’। তবে অনিয়মের অভিযোগ ছিল আগের মতোই, সহিংসতায় তিনজন প্রাণও হারায়।

নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেষ ধাপে অনিয়ম-গোলযোগ-সহিংসতা আগের পাঁচ পর্বের চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও নির্বাচনোত্তর সহিংসতা নিয়ে শঙ্কা কাটেনি। দুয়েকটি জায়গায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। এখনও স্বস্তি পাচ্ছি না; কারণ ভোট শেষে কী হয়, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম ভোটের আগে সাংবাদিকদের বলেন, অনিয়ম-গোলযোগ রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শেষ ধাপে ‘সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা’ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

শেষ ধাপের দুটি ইউপির সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন প্রার্থীরা। শনিবারের ভোটের মাধ্যমে নবম ইউপির সাধারণ নির্বাচনে চার হাজার ৮৫ ইউপির ভোট শেষ হল।

প্রথমবারের মতো দলভিত্তিক স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে দেড় ডজন দল অংশ নিলেও মূল লড়াই হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করা নবম সংদের বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে। অনিয়ম-সহিংসতায় পরস্পরকে দোষারোপও করছে দল দুটো।

ফাইল ছবি

ফেব্রুয়ারিতে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী সহিংসতায় শতাধিক লোকের প্রাণহানি, অনিয়ম-গোলযোগের অভিযোগের পর ইসির ‘কঠোর বার্তায়’ শেষ পর্বে ‘ভালো’ ভোটের ‘আশায়’ আছে পর্যবেক্ষক মহলও।

তারা বলছেন, শেষটায় অনেক কিছুই করা সম্ভব ইসির। পরিস্থিতি ভালোভাবে তদারকির মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলেই আস্থা ফিরবে জনগণের।

প্রস্তুতি সম্পর্কে ইসির উপ-সচিব রকিবউদ্দিন মণ্ডল বলেন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছানো হয়েছে নির্বাচনী সরঞ্জাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন টহলে। স্থানীয়ভাবেও নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

ষষ্ঠ ধাপের ভোট তথ্য

>> ভোট ৪৬ জেলার ৯২ উপজেলার ৬৯৮ ইউপিতে।

>> ভোটার ১ কোটি ১০ লাখের বেশি।

>> ভোটকেন্দ্র ছয় হাজার ২৮৭টি।

>> চেয়ারম্যান পদে ৩ হাজার ২২৩ জন, সাধারণ সদস্য পদে ২৫ হাজার এবং সংরক্ষিত পদে ৫ হাজারের বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

>> চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ২৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

>> চট্টগ্রামে মিরসরাইয়ের করেরহাট ও কুমিল্লার মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর ইউপির সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন প্রার্থীরা।

>> এক লাখের বেশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেড় লাখের মতো সদস্য নিয়োজিত থাকছেন ভোটের দায়িত্বে।

এর আগের পাঁচ ধাপে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থীরা ২২৬৭ ইউপিতে ও ধানের শীষের প্রার্থীরা ৩১০ ইউপিতে জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন ৬৯৬ জন।

ইসির হিসাবে প্রথম ধাপে ৭৪ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৭৮ শতাংশ, তৃতীয় ধাপে ৭৬ শতাংশ, চতুর্থ ধাপে ৭৭ শতাংশ ও পঞ্চম ধাপে ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, ইউপি নির্বাচন ‘কিছু বিছিন্ন ঘটনা’ ছাড়া সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপি এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অংশ নিয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘তামাশার’ ভোটে হারলেও রাজনীতিতে জয় হয়েছে বিএনপির। প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দল দখল করে নিয়েছে ভোট। ইসি দেখে-শুনেও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম মনে করেন  জনপ্রিয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ ভোটে ইসি ‘যথা সময়ে’ ‘যথাযথ পদক্ষেপ’ নিলে অনিয়ম-সহিংসতা কমানো যেত।

“এখন শেষ ধাপেও অনেক কিছু করার রয়েছে। তারা চাইলে ভালো নির্বাচন সম্ভব,” বলেন তিনি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সহিংসতা বন্ধে ‘মানসিকতা পরিবর্তনের’ আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “কোনো ধরনের অনিয়মে ছাড় দেওয়া হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের সব ব্যবস্থা থাকবে।”

‘জনপ্রিয় ভোটে বাড়ল সংঘাত’

স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে পরিচিত এই নির্বাচনে এবার সহিংসতা বেড়েছে; রেকর্ড হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংখ্যায়।

চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের ২২০ জনের বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর বাইরে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ও রাঙ্গামাটির কাউখালীর ফটিকছড়িতে স্বতন্ত্র দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পার হয়েছেন।

তফসিল ঘোষণার পর যে শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে তার মধ্যে পাঁচ ধাপের ভোটের দিন মারা যান অন্তত ৩৫ জন; বাকিরা ভোটের আগে-পরের সহিংসতায়। এসময় সংঘর্ষ-হামলায় সহস্রাধিক লোক আহত হন। অনিয়মের কারণে প্রায় তিনশ’ কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে ইসি।

এর আগে এইচ এম এরশাদের শাসনামলে চেয়ারম্যান পদে সর্বোচ্চ ১০০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এবং সহিংসতায় ৮০ জনের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া গেছে।

সহিংসতার ‘অন্যতম চার কারণ’

ইউপিতে এবারই প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য পদে নির্দলীয়ভাবে ভোট হচ্ছে।

ভোটে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিশৃঙ্খলা, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর ‘দুর্বলতা’ এবং ইসির ‘যথাযথ ক্ষমতা’ প্রয়োগ না করাকে সহিংসতার অন্যতম কারণ মনে করা হচ্ছে।

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন, দলীয় প্রার্থী ও বিদ্রোহীদের জেতার জন্য ‘ডু অর ডাই’ সিচুয়েশন সহিংসতার দিকে নিয়ে গেছে পরিস্থিতি। প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকাও গোলযোগ বাড়ার কারণ।

সহিংসতা রোধ না হওয়ার ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রও এড়াতে পারে না মন্তব্য করে ‘ভালো নির্বাচনের’ জন্য রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের সহায়তার উপর গুরুত্বরোপ করেন তিনি।

এসময় তৃণমূলের এই নির্বাচন দলীয় প্রতীকে আংশিকভাবে না করে সব পদেই করার পক্ষে মত দেন অধ্যাপক কলিমুল্লাহ।

ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিচালক আব্দুল আলীম বলেন, “এবার ভোটে শাস্তির বড় অভাব দেখা গেছে। শুরুতেই ভুল হয়েছে ইসির। ইসি তাদের ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ প্রথম থেকে করতে পারলে এতো হতাহতের ঘটনা হয়ত ঘটত না।”

নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, “অনিয়ম-সহিংসতা রোধে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে আমরা ভালো ব্যবস্থা নিয়েছি; সবসময় মনিটরিং করেছি। এরপরও প্রার্থী, ভোটার ও সামগ্রিকভাবে সংশ্লিষ্টদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে জনপ্রিয় ভোটের খারাপ সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া মুশকিল।”

ফাইল ছবি

দেশের চার হাজার ৫৫৫টি ইউপির মধ্যে এবার ছয় ধাপে চার হাজার ৮৫ ইউপিতে ভোট হচ্ছে। এরমধ্যে গত ২২ মার্চ প্রথম ধাপে ৭১২ ইউপির, ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপে ৬৩৯ ইউপির, ২৩ এপ্রিল তৃতীয় ধাপে ৬১৪ ইউপির, ৭ মে চতুর্থ ধাপে ৭০৩ ইউপির এবং ২৮ মে পঞ্চম ধাপে ৭১৭ ইউপির ভোট হয়।

পাঁচ ধাপে তিন হাজার ৩৮৫ ইউপির ভোট শেষে ষষ্ঠ ধাপে প্রায় ৭০০ ইউপিতে ভোটের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে নবম ইউপির ভোট।

ছয় ধাপের ভোট শেষে আদালতের বাধা কাটলে ও মেয়াদোত্তীর্ণ সাপেক্ষে সুবিধাজনক সময়ে হবে বাকি ইউপির নির্বাচন।