বিনা ভোটে ‘পার পাওয়ায়’ রেকর্ড

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীর সংখ্যা ২১২-তে পৌঁছেছে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2016, 06:36 PM
Updated : 23 May 2016, 06:36 PM

এই সংখ্যা ১৯৮৮ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের দ্বিগুণেরও বেশি। জাতীয় পার্টির শাসনামলের আলোচিত ওই ইউপি ভোটে ১০০ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার রেকর্ড রয়েছে।

নবম এই ইউপি নির্বাচন হচ্ছে ছয় ধাপে। এতে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান পদে লড়াই হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মকর্তারা জানান, শেষ ও ষষ্ঠ ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নৌকা প্রতীকের ১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ নিয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২১২ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোটের আগেই ‘পার’ হয়ে গেলেন।

অনেক ইউপিতে বিএনপি প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা ও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে চাপের অভিযোগের মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে এলেন।

তৃণমূলের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই নির্বাচনে অনিয়ম, সহিংসতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপকতায় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে রয়েছে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসিও।

সহিংসতা-অনিয়মের পরও তুলনামূলকভাবে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন হচ্ছে দাবি করে সিইসি কাজী রকিব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের রেকর্ডকেও স্বাভাবিক মনে করছেন।

ইসির জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রথম ধাপে ৫৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩৪ জন, তৃতীয় ধাপে ২৯ জন,  চতুর্থ ধাপে ৩৫ জন, পঞ্চম ধাপে ৪২ জন ও শেষ ধাপে ১৮ জন নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

ষষ্ঠ ধাপে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল বুধবার। সোমবার পর্যন্ত মাঠ পর্যায় থেকে ১৮টি ইউপিতে একক চেয়ারম্যান প্রার্থীর তথ্য এসেছে ইসিতে।

এরমধ্যে রয়েছে বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাটের গাংনী, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরল, চাঁদপুরের মতলব উত্তরের কলাকান্দা ও গজরা, রাঙ্গামাটির কাউখালীর ফটিকছড়ি, টাঙ্গাইলের কালিহাতির দশকিয়া, ঢাকার সাভারের তেঁতুলঝোড়া, নরসিংদীর পলাশের চরসিন্দুর ও জিনারদা, মাদারীপুরের শিবচরের ভদ্রাসন, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের চরকুমারিয়া ও রামভদ্রপুর, পিরোজপুর সদরের শংকরপাশা, ভোলার চরফ্যাশনের চরকুকুরীমুকুরী, ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুর, পাবনা সদরের গয়েশপুর, বগুড়া সদরের ফাঁপোর ও শাজাহানপুরের আশেকপুর।

নির্বাচনে দুটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য পদে সহস্রাধিক প্রার্থী বিনা ভোটে ‘পার’ হয়েছেন।

ইসির তথ্য অনুসারে, প্রথম চার ধাপে যথাক্রমে ৭৪, ৭৮, ৭৬ ও ৭৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। বাকি দুই ধাপের ভোট ২৮ মে ও ৪ জুন।

২০০৩ সালের ইউপি নির্বাচনে ৮০ দশমিক ২৪ শতাংশ ভোট পড়ে।

বিনা ভোটের আগের রেকর্ড

১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৩ ও ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদে সাধারণ নির্বাচন হয়। এবার হচ্ছে নবম ইউপি নির্বাচন।

ইসির উপ সচিব ও ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, আগের আটটির মধ্যে শুধু ২০০৩ সালের নির্বাচনের পুরো প্রতিবেদন রয়েছে ইসিতে। ওই প্রতিবেদনেই সহিংসতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সর্বোচ্চ তথ্য রয়েছে ১৯৮৮ সালের।

১৯৮৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ১০০ জন ও ওয়ার্ড সদস্য পদে ৬০০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

১৯৯২ সালে চারটি ইউপিতে চেয়ারম্যান ও  সব সদস্য পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেকর্ড রয়েছে।

১৯৯৭ সালের নির্বাচনে ৩৭ জন চেয়ারম্যান, ১০৯৬ জন সাধারণ ওয়ার্ডের সদস্য ও ৫৯২ সংরক্ষিত সদস্য প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হন।

২০০৩ সালে (জানুয়ারি-মার্চ) ইউপি ভোটে ৩৪ জন চেয়ারম্যান, ৬৫১ জন সাধারণ সদস্য ও ৪৫২ জন সংরক্ষিত সদস্য প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

সর্বশেষ ২০১১ সালের ইউপি ভোটে বিনা ভোটে জয়ের তেমন রেকর্ড নেই বলে জানান জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ফরহাদ হোসেন।

সহিংসতায়ও এগিয়ে ১৯৮৮

চলমান নির্বাচনের সহিংসতায় অন্তত ৭৫ জন নিহতের তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে। আরও দুই ধাপের ভোট বাকি রয়েছে।

ইসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয় ১৯৮৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির ভোটে। এতে সরকারি সূত্রে নিহতের সংখ্যা ৮০ ও আহত ৪৭৬ বলে উল্লেখ করা হয়। গণমাধ্যমে আহতের সংখ্যা ৫ সহস্রাধিক বলা হয়। ওই ভোটের পর নির্বাচনী সন্ত্রাস বাড়ায় হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ ১৯৮৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণাও দেন।

ইসির উপ সচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, ওই নির্বাচনে নিহতের সংখ্যা ছিল শতাধিক, দেড় হাজার কেন্দ্র ভোটের দিন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালের ভোটের পরিবেশ ছিল সবচেয়ে ভালো।

তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালের ইউপি নির্বাচনে ৩১ জন নিহত ও ৪৭৭ জন আহত। সে নির্বাচন কেন্দ্র করে ২৯০টি সংঘর্ষ হয়।

২০০৩ সালে তিন মাসব্যাপী ইউপি ভোটে নির্বাচনপূর্ব ৪৫টি, নির্বাচন চলাকালীন ২০টি ও নির্বাচনপরবর্তী ৩৪টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গণমাধ্যমে আসে। তবে এক চতুর্থাংশ হত্যাকাণ্ডের কারণ উল্লেখ ছিল না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

ভোটের চিত্র পর্যালোচনা করে এরশাদের শাসনামলের মন্ত্রী মিজানুর রহমান শেলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৯৮৮ সালের ইউপি নির্বাচন ছিল খুবই সহিংসতাপূর্ণ, অনিয়মে ভরা। ওই ভোট নিয়ে এখন তুলনাই করব না।

“কিন্তু আমরা অনেক দূর এসেছি। এতো বছর পর ইউপি ভোটের বর্তমান চিত্র হতাশাজনক। এভাবে অনিয়ম-সহিংসতা চললে মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে অনীহা তৈরি হবে।”

নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে ইসির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও ‘দায়িত্বশীল ভূমিকা’ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।