সরোদের সুরে অন্যরকম কবিতাসন্ধ্যা

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের সরোদ সুর, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের আবৃত্তিতে এক সন্ধ্যা পার করল শিল্পকলা একাডেমির  চিত্রশালা মিলনায়তনে জড়ো হওয়া দর্শক শ্রোতারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2016, 06:34 PM
Updated : 14 May 2016, 06:34 PM

সরোদের সুরে দুই খণ্ডের আবৃত্তি সিডির মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যার এই আয়োজন।

অনুষ্ঠানে হেদায়েতুল্লা আল মামুনের লেখা তিনটি গান গেয়ে শোনান কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক তানভীর আলম সজীব।

সিডির প্রথম খণ্ডে আবৃত্তি করা হয়: জীবনানন্দ দাশের ‘বনহংস’, ‘আকাশলীনা’, ‘বনলতা সেন’, ‘এই পৃথিবীতে’, ‘তোমরা যেখানে সাধ’; কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাঁঝের পাখিরা’, ‘তোমার আমার এই বিরহে’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাল রাতের বেলা’, ‘আমি কান পেতে রই’, ‘ভালবেসে সখী’, ‘আমরা দুজন’, ‘হঠাৎ দেখা’, ‘শেষের কবিতা’।

দ্বিতীয় খণ্ডে হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন একে একে স্বরচিত ২২টি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান।

উভয় খণ্ডে কবিতার সঙ্গে সরোদের সুর দিয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সরোদ ও সেতার শিল্পী ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানের ছেলে এবং ওস্তাদ আয়াত আলী খানের পৌত্র ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান।

আয়াত আলী সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসাবে কর্মরত রয়েছেন।

‘চন্দন জোছনায় বিবর্ণ মেঘ’ এবং ‘বিস্মরণের ডাহুক’ নামে তার দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পর্বে হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন শুরু করেন কবি জীবনানন্দ দাশের ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে’ কবিতাটি দিয়ে।

এরপর তিনি স্বরচিত ‘আড়াল’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান।

‘তুমি প্রথমেই তোমার ওড়না দিয়ে একটা আড়াল তৈরি করলে তোমার সাথে আমার তখনো তাতে তোমার গন্ধ, স্পর্শ ছিল স্পষ্ট/ তুমি বললে কারণটা সামাজিক/ খানিক আড়াল করা মঙ্গলজনক/ তারপর ভারী চাদর পাতলা ওড়নাটাকে প্রতিস্থাপন করলো…/ তারপর খুব দ্রুতই মোটা চাদরকে প্রতিস্থাপন করলো/ ছয় ইঞ্চি দেয়াল, বার ইঞ্চি, আঠারো ইঞ্চি করে করে এক সময় তা চীনের প্রাচীরের মতো দুর্ভেদ্য… হয়ে গেল/ আমরা দুজন চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম/ তুমি দুর্লঘ্য দেয়ালের ওইপাশে থাকায় জিজ্ঞাসা করা হলো না/ কেন এমন করলে, কেন এমন হলো?’

সব শেষে তিনি আবৃত্তি করেন শেষের কবিতা থেকে: ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও’।

এরপর হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের লেখা গান গেয়ে শোনান কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক তানভীর আলম সজীব।

প্রথমে তিনি শোনান, ‘এখন তুমি কোথায় আছো, এই পৃথিবীর কোন কিনারে/আমরা কথা ভাবতে গিয়ে মন কাঁপে কি সন্ধ্যাকালে’।

এরপর তার সুর ও কণ্ঠে বেজে উঠে, ‘রাত নিজ্ঝুম তারা ঝিলমিল,… চাঁদ জেগে থাকে, রাত জাগা পাখি পাতার আড়লে, কী মোহিনী সুরে ডাকে’ এবং ‘চুলটা তোমার এলোমেলো, নাকি তোমার মনটা তোমার আগোছালো’।

মোড়ক উন্মোচন করেন কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল মাসুদ আহমেদ, নায়ক ফারুক আহমেদ, সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, ফাল্গুনী হামিদ প্রমুখ।

এছাড়া কবির জীবনসঙ্গী সোহেলী আনার মামুনও এ সময় উপস্থিত ছিলেন, যাকে আবৃত্তির এই সিডি উৎসর্গ করা হয়েছে।

শিক্ষা জীবনের দুই বন্ধু মামুন ও শাহাদাতের যুগলবন্দি ‘কবিতা ও সুর’-এর মোড়ক উন্মোচনের পূর্বে অনুভূতি জানাতে মঞ্চে ডাকা হলে শাহাদাত বলেন, “কথা বলার অভ্যাস আমার তেমন একটা নেই। কারণ আমরা যন্ত্র বাজিয়ে আমাদের ভাব প্রকাশ করি।

“আজকে যে ব্যাপারটা হচ্ছে, দুজনে একদিন বসে হঠাৎ কথা হয়, আমরা এই রকম একটা কিছু করতে পারি কি-না, সরোদের সাথে কবিতা। এইভাবে শুরু হয়।”

“প্রথমে কবিতার রেকর্ডিং হয়েছে। রেকর্ডিংয়ের পর আমাকে দিয়েছে। আমি সেটাকে মিলিয়ে মিলিয়ে বাজিয়েছি। মিক্সিংটা পরে হয়েছে। আমার যতদূর মনে হয়, এটা বাংলাদেশে প্রথম। আমি এর আগে ভারতে একটা করেছি। আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে, আপনাদের কাছে ভালো লাগার কথা। কবিতার নির্বাচন দারুণ হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নাই। এখানে একটা নতুন ধারা আছে।”

প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিনয়ের প্রকাশ পেল হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের কণ্ঠেও।

তিনি বলেন, “যদিও এটা কবিতা, আমি কবিজনদের খুব একটা আমন্ত্রণ জানাইনি। একইভাব আবৃতিকারদেরও খুব একটা আমন্ত্রণ জানাইনি। কারণ আবৃত্তিগুলো আবৃত্তি হয়েছে কি-না, আমার সন্দেহ আছে। দুজন কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, যারা আমার যেকোনো কবিতাকে কবিতা হিসাবে মেনে নেন, একজন নাসির আহমেদ, আরেকজন কবি শাহজাদী আঞ্জুমান আরা।

“সরোদে সুর দিয়েছেন শাহাদাত হোসেন খান। মূলত তার আড়ালে আমি আমার সীমাবদ্ধতাকে ঢাকতে চেয়েছি। তবু তিনি রাজি হয়েছে, আমার সীমাবদ্ধতাকে ঢাকতে। উপমহাদেশের একজন বড় শিল্পী তার সরোদ বাদনের সুরের বাঁধনে আমার সীমাবদ্ধতাকে ঢেকে দিয়ে একটা যুগলবন্দি করেছেন। আমার পৌত্র-দৌহিত্র যারা আসবে, তারা বলবে আমার পিতামহ মাতামহ শাহাদাৎ হোসেন সাহেবের সাথে একটা যুগলবন্দি করেছেন।”

অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের প্রধান অতিথি হিসাবে থাকার কথা থাকলেও তিনি আসতে পারেননি। তার পাঠানো লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয় অনুষ্ঠানে।

তোফায়েল বলেন, “এই যুগলবন্দি উন্মোচন বাংলা সংস্কৃতিতে এক নতুন সংযোজন। কবিতা ও সরোদের সুরে দেবে এক অনিন্দ্য প্রশান্তি। আমরা এতদিন হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনকে জেনেছি, একজন দক্ষ, বিচক্ষণ আমলা হিসাবে, আজ তাকে চিনলাম, এক নতুন রূপে।”