চাপাতিতে হত্যা: ঘটনাক্রম

লেখক, শিক্ষক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ভিন্ন মতের ইসলামী ভাবধারা অনুসারী ও বিদেশির পর এবার দুর্বৃত্তের চাপাতির আঘাতে মারা গেলেন সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার এক কর্মী।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবকামাল তালুকদার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2016, 05:44 PM
Updated : 6 Jan 2017, 06:17 AM

এর অধিকাংশ ঘটনা রাজধানী ঢাকা ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ঘটলেও গত কয়েক মাসে হামলার সংখ্যা ও বিস্তৃতি বেড়েছে।  

প্রায় সবগুলো ঘটনাতেই খুনিরা ব্যবহার করেছে ধারালো অস্ত্র। কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে এর সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রও তারা ব্যবহার করেছে।

বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, খুনীরা ছিল তিনজন; মোটরসাইকেলে করে এসে এক মিনিটেরও কম সময়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা পালিয়ে গেছে। কয়েকটি ঘটনায় হামলাকারীরা বিস্ফোরকও ব্যবহার করেছে। 

প্রায় প্রতিবারই হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিদল আইএস অথবা আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা-একিউআইএস দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দিয়েছে জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’।  

তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই দাবি নাকচ করে বরাবরই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বাইরের কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনো অস্তিত্ব নেই। ‘দেশে জন্ম নেওয়া জঙ্গিরা’ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।

গত ১২ বছরে এ ধরনের যত হামলা:

রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদ

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক হুমায়ূন আজাদকে কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে ১২ অগাস্ট তিনি মারা যান।

২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুসকে বিনোদপুরের কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

আহমেদ রাজীব হায়দার

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি: একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর পর সেই রাতে রাজধানীর পল্লবীর বাসার কাছে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে।

২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল: বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফ রায়হান দ্বীপকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ৮৩ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

পীর লুৎফর রহমানের ছবি হাতে স্বজন

২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর: সন্ধ্যায় গোপীবাগে গলা কেটে হত্যা করা হয় কথিত পীর লুৎফর রহমানসহ ছয়জনকে।

২০১৪ সালের ১ অগাস্ট: সাভারে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আশরাফুল আলমকে।

নুরুল ইসলাম ফারুকী

২০১৪ সালের ২৭ অগাস্ট: রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকীকে।

২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

অভিজিৎ রায়

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি: একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চাপাতির কোপে মারা যান মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়। হামলায় গুরুতর আহত হন তার স্ত্রী।

২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল: ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় নিজের বাসা থেকে বের হওয়ার পর রাস্তায় খুন হন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু।

২০১৫ সালের ১২ মে: সিলেটে বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে একই ধরনের হামলায় খুন হন আরেক মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। তিনিও গণজাগরণ মঞ্চে যুক্ত ছিলেন।

নিলাদ্রী নিলয়

২০১৫ সালের ৭ অগাস্ট:  দিন-দুপুরে ঢাকার পূর্ব গোড়ানের এক বাসার পঞ্চম তলার বাসায় ঢুকে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের আরেক কর্মী নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে।

২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর: চট্টগ্রামে কথিত এক ফকিরের আস্তানায় ঢুকে ফকিরসহ দুইজনকে গলা কেটে হত্যা করে বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর: ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশানে চেজারে তাভেল্লা নামের এক ইতালীয় নাগরিককে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। 

কুনিও হোশি

২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর: রংপুরের কাউনিয়ায় মুখোশধারীদের গুলিতে নিহত হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি , যিনি ওই এলাকায় একটি জমি ইজারা নিয়ে ঘাসের খামার করেছিলেন।

২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর: ঈশ্বরদীর ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’ এর ফাদার লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

একই দিন রাজধানীর বাড্ডায় নিজের বাড়ির খানকা শরিফে খুন হন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খান।

২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর: ঢাকায় গাবতলীতে একটি তল্লশি চৌকিতে পুলিশের এক এএসআইকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়।

২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর: রাজধানীর হোসাইনী দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির মধ্যে ফাটানো হয় গ্রেনেড। এতে দুজন নিহত হন, আহত হন শতাধিক।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর: ঢাকার হামলা হয় অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয়ে। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।

ফয়সল আরেফিন দীপন

শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ফয়সল আরেফিন দীপনকে।

২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর: সাভারের আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় শিল্প পুলিশের এক কনস্টেবলকে।

২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর: রংপুর শহরে বাহাই সম্প্রদায়ের এক নেতাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালায় মোটরসাইকেলে আসা তিন হামলাকারী।

২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর: রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের চৈতার মোড়ে এক মাজারের খাদেমকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

একই দিন ঢাকা সেনানিবাসের প্রবেশমুখে তল্লাশি চৌকিতে দায়িত্বপালনকালে মিলিটারি পুলিশের সদস্য ল্যান্স কর্পোরাল সামিদুল ইসলামকে হত্যার চেষ্টা হয়।

২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর: দিনাজপুরে পিয়েরো পারোলারি নামে এক ইতালীয় পাদ্রীকে হত্যার চেষ্টা হয় গুলি করে।

২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর: মাগরিবের নামাজের সময় বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত হন, আহত হন আরও চারজন।

২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর: দিনাজপুরের কাহারোলে ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে এক মেলায় বোমা হামলা হয়।

২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর: বগুড়ার কাহারোলে ইসকনের এক মন্দিরে ঢুকে গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়। একই দিনে চুয়াডাঙ্গায় খুন হন স্থানীয় বাউল উৎসবের এক আয়োজক। পরদিন তার লাশ পাওয়া যায়।

২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর: চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটি ঈসা খাঁ মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী হামলা হয়। এ ঘটনায় ছয়জন আহত হন, গ্রেপ্তার হন দুজন।

২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর: রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত হন, আহত হন বেশ কয়েকজন।

২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি: ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বালেখাল বাজারে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক সমির আলিকে হত্যা করা হয়, যিনি ২০০১ সালে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। খুনিরা চেম্বারে ঢুকে সমিরকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। পরে আইএস এর দায় স্বীকারের বার্তা আসে।

২০১৬ সালের ১৫ মার্চ: ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের একাংশের ঝিনাইদহ জেলা শাখার সেক্রেটারি আব্দুর রাজ্জাককে কালীগঞ্জ উপজেলার নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজ্জাক পেশায় ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। আইএস ওই হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে সে সময় খবর আসে।

নাজিমুদ্দিন সামাদ

২০১৬ সালের ৮ এপ্রিল: রাতে রাজধানীর সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে।

২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করীম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল:
ঢাকার কলাবাগানের লেক সার্কাসে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউএসএআইডি এর কর্মসূচি কমকর্তা জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে। তারা দুজনেই ছিলেন সমকামী অধিকার কর্মী।

২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল: টাঙ্গাইলে দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদারকে তার দোকানের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

২০১৬ সালের ১৪ মে: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি চাকপাড়া বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু মং শৈ উ’ কে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

২০১৬ সালের ২০ মে: কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়নে শিশির মাঠ এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক মীর সানোয়ার হোসেনকে।তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন তার বন্ধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামসুজ্জামান।

২০১৬ সালের ৫ জুন: নাটোরে খ্রিস্টান মুদি দোকানি সুনীল গোমেজকে তার দোকানে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

২০১৬ সালের ৫ জুন: চট্টগ্রামের ওআর নিজাম রোডে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে।

২০১৬ সালের ৭ জুন: ঝিনাইদহের নলডাঙ্গা মন্দিরে পুরোহিত অনন্ত গোপাল গাঙ্গুলীকে গাঁয়ের রাস্তায় গলা কেটে হত্যা করা হয়। 

২০১৬ সালের ১ জুলাই: ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাষ্ঠসাগরা গ্রামের শ্রী শ্রী রাধামদন গোপাল বিগ্রহের (মঠ) সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে মোটর সাইকেলে আসা তিন যুবক কুপিয়ে হত্যা করে।