কেরানীগঞ্জে উদ্বোধনের অপেক্ষায় পদ্মা যমুনা চম্পাকলি

সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করে উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে পদ্মা, যমুনা, করতোয়া, বকুল, শাপলা, চম্পাকলিরা। নদীর সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে মিলিয়ে নাম পেয়েছে কেরানীগঞ্জের নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভবনগুলো।

আসাদুজ্জামান সুমনকামাল হোসেন তালুকদার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2016, 04:54 AM
Updated : 8 April 2016, 01:15 PM

ঢাকা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-মাওয়া সড়কের দক্ষিণে রাজেন্দ্রপুরে এই কারাগারের বন্দি ধারণ ক্ষমতা চার হাজার ৫৯০ জন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১০ এপ্রিল প্রায় ৩১ একর জমির ওপর নির্মিত নতুন এই কারাগার উদ্বোধন করবেন।

উদ্বোধন উপলক্ষে এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত উদ্বোধনী ফলক তৈরি হয়ে গেছে। সব ঠিকঠাক কিনা- ঘুরে ঘুরে দেখছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডে বর্তমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নতুন কারাগারের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার।

নতুন কারাগার উদ্বোধনের পরপরই পুরনো কারাগার থেকে অতিরিক্ত বন্দিদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হবে বলে জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির জানিয়েছেন।

১৭৮৮ সালে স্থাপিত নাজিম উদ্দিন রোডের কারাগারের ধারণ ক্ষমতা দুই হাজার ৮২৬ জন হলেও সেখানে বন্দি আছে প্রায় তিনগুণ।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জ

>> অবস্থান: তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুরে

>> ব্যয়: ৪০৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা

>> আয়তন: ৩১ একর

>> ধারণ ক্ষমতা: চার হাজার ৫৯০ জন

>> নির্মাণ শুরু ২০০৭ সালে

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের আলোচনা শুরু হয়েছিল সেই আশির দশকে। তার তিন দশক পর ২০০৬ সালে বিষয়টি একনেকে পাস হলে শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ। পরের বছর সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।

বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, কারাগারের উদ্বোধন উপলক্ষে চলছে শেষ পর্যায়ের ঘষা-মাজা। কারাগারের সামনে প্রায় ২০০ কারারক্ষী পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন।

প্রধান সড়ক থেকে কারাগারের প্রধান ফটক পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় দুইশ গজ। প্রধান ফটকে বড় হরফে লেখা- ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জ’।

ফটকের বাঁ পাশে রির্জাভ গার্ড হাউজ, তারও বাঁয়ে বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ভবন। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই ডানপাশে দৈনিক রসদ গ্রহণ ও বিতরণ কক্ষ; তারপর ভর্তি শাখা ও মুক্তি শাখা। আর ফটকের পাশে রয়েছে জেলারের কক্ষ।

প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ডান দিকে তাকালে দেখা যাবে ‘পদ্মা’, তার দক্ষিণে ‘যমুনা’, তারপর ‘মেঘনা’।

পদ্মা ও মেঘনা এরইমধ্যে প্রস্তুত হলেও যমুনার কিছু কাজ এখনও বাকি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়. শ্রমিকরা নিচতলায় গ্রিল লাগানোর কাজ করছেন। রংয়ের কাজও বাকি রয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান আফতাব উদ্দীন নামে এক মধ্যবয়সী শ্রমিক।

 

# ছয়টি ছয়তলা ভবনে হাজতি এবং একই ধরনের দুটি ভবনে কয়েদিদের রাখা হবে।

# এসব ভবনের প্রতি তলায় ৪০টি করে কক্ষ; প্রতি কক্ষে ১৩ জন করে বন্দি রাখার ব্যবস্থা।

# ২০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ প্রস্থের প্রতিটি কক্ষে থাকবে চারটি করে সিলিং ফ্যান। পাশেই বাথরুম।

# চারটি চারতলা ভবন হবে ডেঞ্জার সেল। ৪০০ দুর্ধর্ষ জঙ্গি ও সন্ত্রাসীকে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে।

# ডিভিশনপ্রাপ্ত (ভিআইপি) বন্দিদের জন্য ১৬টি বিশেষ কারাকক্ষ।

মেঘনার পূর্বপাশের ভবনটি ‘চম্পাকলি’, যেখানে ‘ভিআইপি’ বন্দিদের রাখা হবে। আর চম্পাকলির উত্তরে ‘সুরমা’য় রাখা হবে কিশোর অপরাধীদের।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার আরিফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিশোর অপরাধীদের কাশিমপুরে কিশোর সংশোধানাগারে পাঠানো হবে। তবে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছর, তাদের সুরমায় রাখা হবে।”

তিনি জানান, হাজতিদের রাখা হবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, করতোয়া ও মনিহারে। কয়েদিরা থাকবেন মধুমতি ও রূপসায়।

‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’, জঙ্গি ও গুরুতর মামলার আসামিদের রাখা হবে ‘ডেঞ্জার সেল’বনফুল, বকুল, শাপলা ও সূর্যমুখী নামের চার ভবনে। চারতলা এসব ভবনের প্রতি কক্ষেই টয়লেট ও ফ্যান রয়েছে।

ফাঁসির মঞ্চ রয়েছে কারাগারের দক্ষিণ অংশের সীমানা প্রাচীরের কাছে বনফুলের সীমানার মধ্যে। ফাঁসির মঞ্চটি দক্ষিমুখী এবং মঞ্চের ওপর ছাউনি রয়েছে। একই মঞ্চে এক সঙ্গে দুজনকে ফাঁসি দেওয়া যাবে।

নিরাপত্তা

নতুন এ কারাগারের ডেঞ্জার সেলগুলো কাছাকাছি। বনফুলের উত্তরে বকুল আর পূর্বপাশে শাপলা। আর বকুলের পূর্বপাশে সূর্যমুখী।

এই চার কারা ভবন ঘিরে আছে ১৮ ফুট উচ্চতার সীমানা প্রাচীর। তার ওপর দুই ফুট বৈদ্যুতিক তারের সেন্সর। প্রতিটি ভবনের রয়েছে আলাদা ছোট প্রাচীর।

কোনো আসামি ১৮ ফুট দেয়াল টপকে যেতে চাইলে তারের সেন্সরে স্পর্শ লাগামাত্র নিরাপত্তা ঘণ্টা বেজে উঠবে। সেই সঙ্গে পলায়নপর কয়েদীকে খেতে হবে বৈদ্যুতিক শক। এখানে এক ভবনের আসামি অন্য ভবনের যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর বাঁ দিকের পূর্বপাশে নজরে আসবে কর্ণফুলী, তার দক্ষিণে করতোয়া। করতোয়ার দক্ষিণে মনিহার।

ফটক দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকলে প্রথমে বাঁ পাশে গ্রন্থাগার এবং তার উত্তরে মানসিক বন্দিদের জন্য জলসিঁড়ি ভবন। জলসিঁড়ির পূর্বপাশে এমআই ইউনিট ভবন। সেখানে এক সঙ্গে আটজন বন্দিকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যাবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।

জলসিঁড়ি ভবনের পর বিশাল খালি জায়গায় ‘কেইস টেবিল শেড’। কোন আসামিকে কোন ভবনে নেওয়া হবে তা নির্ধারণ করা হয় এই শেডে বসে। আসামিদের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে সেখানে এনে সাময়িক বিচারও করা হয়।

কেইস শেডের দক্ষিণ-পশ্চিমে মধুমতী ভবন আর পূর্বে সুরমা। অবশ্য সুরমার অনেক কাজ এখনো বাকি।

সুরমার দক্ষিণে ওয়ার্ক শেড আর ওয়ার্ক শেডের পূর্বে রয়েছে আটার মিল।

দোতলা ওয়ার্ক শেডে বড় বড় চারটি কক্ষ রয়েছে। সেখানে বন্দিরা কী কী কাজ করবেন- তা এখনো নির্ধারণ হয়নি বলে ডেপুটি জেলার আরিফুর রহমান  জানান।

তিনি জানান, চম্পাকলিতে ১৬টি ভিআইপি কক্ষ রয়েছে, যাতে ১৬ জন ভিআইপি বন্দি থাকতে পারবেন।

“বাংলাদেশের অন্য কারাগারের চেয়ে এটি অনেক আধুনিক। অপরাধীরাও তো মানুষ। যতোটা সম্ভব খোলামেলা ও সুন্দর পরিবেশ রাখার চেষ্টা হয়েছে।”

- কেরানীগঞ্জ কারাগারের অন্যতম স্থপতি নুসরাত জাহান

কারাগারের ভেতর সেলুন ও লণ্ড্রি ভবনও রয়েছে। আর সবকিছু পর্যবেক্ষণের জন্য কারাগারের চারপাশে রয়েছে ৪০ ফুট উঁচু চারটি ওয়াচ টাওয়ার।

কারাগারের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে রয়েছে ব্যারাক দুর্জয়। ৯৬টি কক্ষে প্রায় ৪০০ কারারক্ষী সেখানে থাকতে পারবেন।

কারাগারের পশ্চিশ পাশে তৈরি করা হয়েছে আবাসিক এলাকা। ৬০০ বর্গফুট আয়তনের ১৭টি ভবন সেখানে তৈরি হচ্ছে। ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ছাড়াও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য ১২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটও তৈরি করা হয়েছে।

এ কারাগারে কেবল পুরুষ বন্দি রাখা যাবে জানিয়ে কারা কর্মকর্তা আরিফুর বলেন, “নারী বন্দিদের জন্য পাশেই আরেকটি কারাগার তৈরি হচ্ছে।”