সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৭১২টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ ও গণনার সময় পাঁচ জেলায় সহিংসতার মধ্যে অন্তত ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
Published : 22 Mar 2016, 10:27 PM
মঙ্গলবার ভোট চলাকালীন সময় ঝালকাঠিতে প্রতিপক্ষের হামলায় এক মেম্বার প্রার্থীর ভাই নিহত হন বলে পরিবারের অভিযোগ।
আর পিরোজপুর, নেত্রকোণা, কক্সবাজার ও সিরাজগঞ্জের চারটি ইউনিয়নে দিনভর ভোটগ্রহণ শেষে রাতে গণনার সময় সংঘাত বাঁধে।
এতে পিরোজপুরে পাঁচজন, কক্সবাজারে তিনজন এবং সিরাজগঞ্জ ও নেত্রকোণায় একজন করে নিহত হন বলে পুলিশকে উদ্ধৃত করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
নবম ইউপি ভোটের প্রথম ধাপে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সারাদেশে ৭১২টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ চলে।
দলীয় প্রতীকে প্রথম অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে গোলযোগ-অনিয়মের কারণে ৬৫ কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়।
ঝালকাঠি
ঝালকাঠির সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নে ভোট চলার সময় এক মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলার মধ্যে আরেক মেম্বার প্রার্থীর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে ইউনিয়নের কালিয়ান্দার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে বলে ঝালকাঠি সদর থানার পরিদর্শক মো. মাহে আলম জানান।
আবুল কাশেম শিকদার (৫৫) নামের ওই ব্যক্তি ইউপি সদস্য প্রার্থী চুন্নু শিকদারের ভাই।
কাশেমের ছেলে সোহাগ সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানোর সময় ইউপি সদস্য প্রার্থী সজীব হোসেনের সমর্থকরা লাঠিসোঁটা দিয়ে তার বাবা ও চাচার সমর্থকদের মারধর করে।
“আহতদের ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানের কর্তব্যরত চিকিৎসক বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন।”
সজীব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্ট করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে।
ঝালকাঠির পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউপি নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রে সহিংসতা ঘটেনি। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা থাকলে তা কেন্দ্রের বাইরে ঘটেছে।”
অবশ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ভোটের লাইনেই দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও লাঠি নিয়ে ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সহকারী মনীন্দ্র নাথ হালদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আবুল কাশেমের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সম্ভবত গণ্ডগোলের মধ্যে তার হার্ট অ্যাটাক হয়। তবে ময়নাতদন্ত করলে মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হবে।”
পিরোজপুর
মঠবাড়িয়া উপজেলার ধানিসাফা ইউনিয়নে ভোট গণনার সময় আওয়ামী লীগের সমর্থকরা কেন্দ্র অবরুদ্ধ করে রাখার পর পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নিহত হন।
ধানিসাফা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে রাত ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে বলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু আশ্রাফ জানান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটসহ নির্বাচনী কর্মকর্তা ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ভোট গণনা চলছিল।
“গণনার শেষ পর্যায়ে ফল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে যেতে থাকলে তার সমর্থকেরা কেন্দ্রটি অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় পুলিশ তাদের সরে যেতে বললেও তারা সরেনি।”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এবং অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি ছুড়লে তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এছাড়া আরও তিনজন বরিশাল নেওয়ার পথে মারা যান বলে পুলিশ কর্মকর্তা আবু আশ্রাফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন।
পরে জেলার পুলিশ সুপার ওয়ালিদ হোসেন জানান, এই ঘটনায় সর্বমোট পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন ঘটনাস্থলে এবং দুজন হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।
নেত্রকোণা
খালিয়াজুড়ি ইউনিয়নে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের সময় একজন ‘গুলিবিদ্ধ’ হয়ে মারা গেছেন।
নিহত গোলাম কাওসার (৩৫) ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আবু ইসহাকের ছোট ভাই।
আদাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, রাত পৌনে ৮টার দিকে একদল যুবক কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়।
এরপর ঘটনাস্থলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাওসারকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
কাওসার পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন কি না- এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খান মো. আবু নাসের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”
ঘটনার সময় অন্য কোনো পক্ষ গুলি ছুড়েছে কি না- এমন প্রশ্ন করলেও তিনি ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানান।
কারা ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিল- জানতে চাওয়া হলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও পুলিশ ‘তদন্ত করা হচ্ছে’ বলে এড়িয়ে যান তিনি।
এ সময় এসআই ফজলুল হক নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন বলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা জানান।
কক্সবাজার
টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দুটি সংঘর্ষে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।
ওই তিন জনের মৃতদেহ সদর হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন কক্সবাজার সদর থানার এসআই মো. আবদুর রহিম।
তবে টেকনাফ থানার ওসি মো. আব্দুল মজিদ দুই জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেও আরেকজনের কথা জানাতে পারেননি।
রাত ১০টার দিকে মাঝের পাড়া কেন্দ্র ও মুন্ডার ডেইল কেন্দ্রে সংঘাত বাধে।
সদর থানার এসআই মো. আবদুর রহিম জানান, তিন জনের মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে রাখা হয়েছে।
নিহতরা হলেন সাবরাংয়ের মুন্ডার ডেইলের আমির হামজার ছেলে আবদুল গফুর (৩৮), একই এলাকার আবদুস সালামের ছেলে মনির আহমেদ (২৮) ও শাহপরীর দ্বীপের মাঝের পাড়ার দুদু মিয়ার ছেলে শফিক উল্লাহ (৩০)।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুলতান আহমদ সিরাজী বলেন, সাবরাংয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ ১০ জনকে রাতে হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে আব্দুল গফুরকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। গভীর রাতে আনা অপর দুই জনকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
আহত অন্যরা চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানান তিনি।
টেকনাফ থানার ওসি মো. আব্দুল মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুন্ডার ডেইল কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে একদল লোক। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলিবর্ষণ করে। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়।”
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আতাউর রহমান জানান, পাঁচজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আনা হয়। এর মধ্যে আব্দুল গফুরকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হলে পথে তার মৃত্যু হয়।
নিহত আব্দুল গফুর (৩৫) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেনের ভাই।
অন্যদিকে ভোটের ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মাঝের পাড়া কেন্দ্রে ইউপি সদস্য প্রার্থী নুরুল আমিন ও মোহাম্মদ সেলিমের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।
স্থানীয়রা জানান, ওই কেন্দ্রে প্রথমে কয়েক ভোটের ব্যবধানে নুরুল আমিনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তা চ্যালেঞ্জ করেন অন্য প্রার্থী সেলিম। পুনঃগণনা শেষে সেলিমকে বিজয়ী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়।
উভয় পক্ষের লোকজন ব্যালেট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলিবর্ষণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে বলে ওসি মজিদ জানান।
সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হন বলে ওসি জানান। সেখানে আরেকজনের মৃত্যু হয়।
সিরাজগঞ্জ
রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া ইউনিয়নে ফল ঘোষণার পর পরাজিত সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় নিহত হয়েছেন বিজয়ী প্রার্থীর এক স্বজন।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে উজয়ানপুর এলাকায় এই ঘটনা ঘটে বলে সহকারী পুলিশ সুপার মোতাহার হোসেন জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জয়ানপুর এলাকায় বিজয়ী ও পরাজিত ইউপি সদস্যের দুগ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে এক নারীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি।”
নিহত নোনাই বেগম (৫৫) ওই এলাকার ইনসাব আলীর স্ত্রী। এই নারী সম্পর্কে বিজয়ী প্রার্থী নবাব আলীর শ্বাশুড়ি হন।
ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়া সিলিং ফ্যান প্রতীকের প্রার্থী নবাব আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরাজয় মেনে না নিয়ে সামিদুল ইসলামের (ফুটবল) লোকজন দেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমার কর্মী-সমর্থক ও আত্মীয়-স্বজনদের উপরে হামলা চালায়।”
হামলাকারীদের লাঠির আঘাতে নোনাই বেগম ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত হন আরও ৮/৯ জন। এদের মধ্যে আব্দুল মালেক নামে একজনকে বগুড়ায় পাঠানো হয়েছে
ভোট সংক্রান্ত আরও খবর