অটোরিকশার মিটারে কারসাজি, ‘নিরুপায়’ পুলিশ

যাত্রীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অটোরিকশায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে মিটার কারসাজি।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 March 2016, 05:36 AM
Updated : 22 March 2016, 07:44 AM
জালিয়াতি করা মিটার নিয়ে যাত্রী-চালকদের মধ্যে অহরহ বচসা-বিতণ্ডা হলেও চুরি ধরার প্রযুক্তি না থাকায় নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ।

যাত্রীদের কাছ থেকে একাধিক অভিযোগ পেয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ট্রাফিক পুলিশ ও মিটার স্থাপনে নিয়োজিত বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এমন তথ্য মিলেছে।

২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা সেবা চালু হয়। দুই স্ট্রোক বেবি ট্যাক্সি/স্কুটারের জায়গায় আসে চার স্ট্রোকের গ্যাসচালিত এই তিন চাকার বাহন।

শুরু থেকেই অটোরিকশা মিটারে চলার নিয়ম হলেও  মাঝে বেশ কয়েক বছর মিটার বন্ধ রেখে যাত্রীদের কাছে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করতেন চালকরা।

গত নভেম্বরে সরকার সর্বশেষ অটোরিকশার ভাড়ার হার বাড়ায়। প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ভাড়া এখন ৪০ টাকা, যা আগে ২৫ টাকা ছিল। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ৭ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২ টাকা।

মালিকদের কাছে চালকদের দৈনিক জমার পরিমাণ ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৯০০ টাকা করা হয়।

তবে নতুন ভাড়ায়ও অটোরিকশায় চড়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে যাত্রীদের। আগের মতোই দরদাম ঠিক করে যেতে চান চালকরা, অনেক ক্ষেত্রে মিটারের চেয়ে বাড়তি ২০ বা ৫০ টাকার দাবি থাকে তাদের।

যেসব চালক মিটারে যান তাদের অনেকের মিটারে কারসাজি থাকছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর বিস্ময়কর রিডিং পেয়ে অনেকে চালকের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতেও জড়াচ্ছেন।

চালকদের মিটারে না যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথা হলেও কারসাজির বিষয়টি রয়ে গেছে আলোচনার বাইরে।

সম্প্রতি যাত্রী ও ট্রাফিক পুলিশের হাতে ‘টেম্পারিং’ করা মিটার ধরা পড়ার পর বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছেও অভিযোগ পৌঁছেছে।

ট্রাফিক পুলিশের মহাখালী অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যাত্রীদের অভিযোগ পেয়ে কয়েকটি অটোরিকশার মিটার যাচাইয়ের জন্য বিআরটিএ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে মিটার কারসাজির প্রমাণও পাওয়া গেছে।

“প্রযুক্তির অভাবে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মিটার যাচাই করতে পারছি না। ফলে ধারণার ওপরেই অনেক অভিযোগের মীমাংসা করতে হচ্ছে।”

কারসাজি

চলতি মাসের শুরুর দিকে বাড্ডায় স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো একটি অটোরিকশায় (ঢাকা থ-১৩৩২০৯) চড়ে লিংক রোড থেকে হাতিরঝিলের পূর্ব প্রান্তে গিয়ে মিটার নিয়ে সন্দেহে পড়েন তিন নারী যাত্রী। হাতিরঝিল হয়ে মগবাজারে একটি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন তারা।

দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ৬৫ টাকা বিল দেখে তর্কে জড়ান যাত্রীরা। এক পর্যায়ে ওই যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেন চালক।

ঘটনা দেখে ওই অটোরিকশায় চড়ে যাত্রীদের ক্ষোভের যৌক্তিকতা পাওয়া যায়।

হাতিরঝিল প্রকল্পের পূর্ব প্রান্ত থেকে তিন দশমিক ৬ কিলোমিটার দূরত্বে বিরতিহীন চড়ে ভাড়া গুণতে হয় ৯০ টাকা, যেখানে ওই টাকায় বিরতিহীনভাবে অনায়াসে ৬ কিলোমিটার পথ পেরোনো যায়।

বেশি ভাড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে চালক বলেন, “মিটার দেখে ভাড়া দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সন্দেহ হলে কিলো হিসাব করে ভাড়া দিয়েন।”

মিটার কারসাজির প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছেন বিআরটিএ-এর মোটরযান পরিদর্শক রুহুল আমিনও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিআরটিএ পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতে বেশ কয়েকটি অটোরিকশার মিটারে কারসাজি পাওয়া গেছে। চালকরা বিভিন্ন আইটি বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে এ কাজটি করিয়ে থাকে।”

অটোরিকশার মিটার ব্যবস্থাপনা ‘দুর্বল’ এবং সেখানে কারসাজির সুযোগ রয়েছে বলে স্বীকার করেন বিআরটিএ-এর এই মোটরযান পরিদর্শক।

‘মিটার ক্যালিব্রেশন’ বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ সুলতান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কয়েকটি কোম্পানির কাছ থেকে সফটওয়্যার লোড করে আনা মিটারগুলো বিআরটিএ-এর পরীক্ষাগারে যাচাই করে সিলগালা (তালাবন্ধ) করা হয়। সিলগালায় সমস্যা থাকলে সেই মিটারকে ত্রুটিপূর্ণ বলে সন্দেহ করা যায়।

“বিআরটিএর পক্ষ থেকে একটি এবং সংশ্লিষ্ট আইটি কোম্পানির পক্ষ থেকে আরেকটি ‘ওয়ানটাইম ইউজ’ তালা দিয়ে মিটারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। তবে এরপারও তার লুজ করে অথবা অন্য কোনো উপায়ে প্রতারণা হয়ে থাকে।”

চট্টগ্রামে দুই হাজার ২৫০টি এবং ঢাকার প্রায় দুই হাজার ৬০০ অটোরিকশায় তাইওয়ানের তৈরি মিটার সরবরাহ করেছে ক্রিস্টাল এজেন্সি নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ওয়ালি উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চালকরা বাইরের মিস্ত্রি দিয়ে কারসাজির কাজটি করিয়ে থাকে।

সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাসওয়ার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা না করলে এ সমস্যার সমাধান করা কঠিন বলে জানান তিনি।