এবার রায়ের অনুলিপির অপেক্ষা

সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকায় একাত্তরের বদর নেতা মীর কাসেম আলীর দণ্ড কার্যকরে এবার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের অপেক্ষা শুরু হলো।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2016, 10:34 AM
Updated : 9 March 2016, 12:36 PM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেন। এরপর পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষার কথা শোনা যায় রাষ্ট্র ও আসামি- দুই পক্ষের মুখেই। 

ওই অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আসামি রায় পর্যালোচনার আবেদন (রিভিউ) করতে পারবেন। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষারও সুযোগ পাবেন। দুটোই নাকচ হয়ে গেলে সরকার দণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে।

এক্ষেত্রে চার যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজনকে হত্যার দায়ে আপিল বিভাগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় এসেছে। আরও ছয় অভিযোগে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।  

রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের রায়ে বলা হয়, রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামি রিভিউ চাইতে পারবেন।

“অপেক্ষা করব এই ১৫ দিনের জন্য। তারা যদি রিভিউ পিটিশন দাখিল না করে, তাহলে আমরা এই রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

মীর কাসেমের স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন এরই মধ্যে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন তারা।

আসামির প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনও বলেছেন, “আমরা পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষা করছি। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পেলে রিভিউ এর উপাদান পাওয়া গেলে রিভিউ দায়ের করা হবে।”

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলমের কথাতেও পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষার বিষয়টি ফুটে ওঠে।

তিনি বলেন, “কী কারণে মৃত্যুদণ্ডের একটা অভিযোগ থেকে মীর কাসেম খালাস পেলেন, সেটা এখনই বলা যাবে না। রায়ের পূর্ণ অনুলিপি পেলে আমরা সেটা বলতে পারব।”

মীর কাসেম আলী, ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার পথে।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে।

ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় দেয় আপিল বিভাগ, যাতে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়।

এর প্রায় আড়াই মাস পর ৫ ডিসেম্বর ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। অনুলিপি পাওয়ার পর ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। দুই পৃষ্ঠার ওই ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ খামে ভরে লাল সালুতে মুড়ে ৭৯০ পৃষ্ঠার নথিসহ পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

১০ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানালেও আসামিপক্ষের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ রাতে এক আকস্মিক আদেশে তা স্থগিত করে দেন। ওই রাতেই কাদের মোল্লার পক্ষে তার আইনজীবীরা দুটি আবেদন করেন।

এর একটিতে রায় পুনর্বিবেচনার এবার রায়ের অনুলিপির অপেক্ষা আবেদন করা হয় এবং দ্বিতীয় আবেদনে রায় পুনর্বিবেচনা করে কাদের মোল্লার খালাসের আবেদন করা হয়।

এরপর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের আবেদনের শুনানি করে তা নাকচ করে দেয় প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।

১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন পরিবারের সদস্যরা। ওইদিন রাত ১০টা ১ মিনিটে এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

কাদের মোল্লার পর আপিলে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার শুনানি হয়। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে সেখানে তাকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় ‘রিভিউয়ের সুযোগ’ রয়েছে কি-না, সেই প্রশ্ন কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায়ের পরপরই সামনে চলে আসে।২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের মামলা নিষ্পত্তি করে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখলে ফিরে আসে সেই আলোচনা।

এর মধ্যে ওই বছরের ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। সেই রায়ে আদালত জানায়, যুদ্ধাপরাধের মামলাতেও সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা যাবে।

রায়ে বলা হয়, আসামি ও রাষ্ট্র- দুই পক্ষই ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে।

ওই রায়ে বলা হয়, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে দণ্ডিতদের ক্ষেত্রেও আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন গ্রহণযোগ্য (মেনটেইনেবল) হবে। তবে তা আপিলের সমকক্ষ হবে না।

২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল পরদিন মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। তার আইনজীবীরা ৫ মার্চ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ৬ এপ্রিল আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়।

রিভিউ আবেদন খারিজের পর প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান এই যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু আসামি প্রাণভিক্ষার জন্য কত সময় পাবেন এবং কতদিনের মধ্যে তার নিষ্পত্তি হবে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া না থাকায় কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা তৈরি হয়।

কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছিল, যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে আসামি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন। তবে প্রাণভিক্ষার জন্য কারাবিধিতে বেঁধে দেওয়া ৭ থেকে ২১ দিনের সময়সীমা এ মামলার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য হবে না। আসামি প্রাণভিক্ষা চাইলে তার নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না। 

কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তিনি প্রাণভিক্ষার সুযোগ নেননি। এ কারণে রিভিউ খারিজের দিনই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।  কিন্তু কামারুজ্জামান সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য কয়েক দফা সময় নিলে জটিলতা দেখা দেয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সে সময় বলেছিলেন, ওই সুযোগ নেবেন কি না- তা জানাতে কামারুজ্জামান ‘যৌক্তিক সময়’ পাবেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, একটি ‘মার্সি পিটিশন’ লিখতে যে সময় লাগে এক্ষেত্রে সেটাই ‘যৌক্তিক সময়’ বলে তিনি মনে করেন।

রিভিউ খারিজের পাঁচ দিনের মাথায় ১১ এপ্রিল বিকালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে চাননি।

ওই সন্ধ্যায় আবারও কামারুজ্জামানের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে দেওয়া হয়। রাত ১০টার পর দ্বিতীয় যুদ্ধাপরাধী হিসাবে এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।

গত ২২ নভেম্বর একই দিনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

একাত্তরে নির্বিচারে অসংখ্য মানুষের প্রাণ সংহার করলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মরিয়া হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিলেন তারা দুইজন। ক্ষমাভিক্ষাও করেছিল রাষ্ট্রপতির কাছে। তবে তা নাকচ করে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

২০১৫ সালের ১৬ জুন আপিলের রায়ে মুজাহিদের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ বহাল রাখা হয়। অন্যদিকে ২৯ জুলাই যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাকা চৌধুরীকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। ৩০ সেপ্টেম্বর এক সঙ্গে দুইজনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।

পরদিন রায়ের কপি ট্রাইব্যুনালে পৌঁছালে জারি করা হয় মৃত্যু পরোয়ানা।১৪ অক্টোবর তারা আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন; ১৮ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত তা খারিজ করে দেয়।

১৯ নভেম্বর রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, পড়ে শোনানো হয় দুই যুদ্ধাপরাধীকে। প্রাণভিক্ষার আবেদন নিষ্পত্তির পর ২১ নভেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয় এই দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড।