জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম ছিলেন আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার যোগানো অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী শক্ত ভিত্তি পায়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেয়। বেঞ্চের অপর চার সদস্য হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
ষোল মাস আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুই অভিযোগে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড এবং আট অভিযোগে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল।
আপিলের রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদকে খুনের দায়ে এক অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং আরও ছয় অভিযোগে ৫৮ বছর কারাদণ্ডের সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর আপিলে আসা এটি সপ্তম মামলা, যার ওপর চূড়ান্ত রায় হলো।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আদালতের ভেতরে-বাইরে উপস্থিতদের স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। আপিল বিভাগের শুনানিতে প্রধান বিচারপতির এক বক্তব্যের পর এই রায় নিয়ে সরকারের দুই মন্ত্রীর বক্তব্যে যে সংশয় ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, তা দূর হয়ে গেছে বলে মত প্রকাশ করেন অনেকে।
রায়ের পর এক বিবৃতিতে মীর কাসেমের স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন বলেন, “আমরা ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছি, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আমরা রিভিউ আবেদন করব।”
আসামির প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনও রিভিউয়ের বিষয়ে একই কথা বলেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘প্রত্যাশিত’ ফল এসেছে। ‘সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও দৃঢ়তার কারণেই’ যুদ্ধাপরাধের বিচার এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
চূড়ান্ত রায়ের পর রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে। কোথাও কোথাও আনন্দ মিছিল হয়।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।
মঙ্গলবার আপিল বিভাগে রায় ঘোষণার সময় তিনি ছিলেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। সেখানেই তিনি রায় শুনেছেন বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
মীর কাসেম আলীর সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল থাকায় সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় আনন্দ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর রায়ের পর শাহবাগে বিজয় চিহ্ন দেখান গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা।
নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ।
পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। তবে রিভিউ যে আপিলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে।
রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিলের রায় ঘিরে মঙ্গলবার ঢাকার হাই কোর্ট এলাকায় পুলিশের সতর্ক অবস্থান।
রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে বদর নেতা মীর কাসেমের ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসিম।
মীর কাসেমের আপিলের ওপর সপ্তম দিনের শুনানি শেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ ৮ মার্চ রায়ের দিন ঠিক করে দিয়েছিল। শুনানিতে প্রধান বিচারপতির এক বক্তব্যের সূত্র ধরে রায় ঘোষণার তিন দিন আগে ৫ মার্চ এক আলোচনায় রায় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বক্তব্য দেন সরকারের দুই মন্ত্রী, যা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়।
সোমবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে রায় ঘোষণার জন্য মীর কাসেমের মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকার এক নম্বরে রাখা হলেও মঙ্গলবার রায়ের দিন সকালে প্রকাশিত সম্পূরক কার্যতালিকায় দেখা যায় ‘ফুল কোর্ট’ বসবে। সেখানে মীর কাসেমের মামলার কথা না থাকায় শুরু হয় গুঞ্জন।
প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের নয় বিচারক সকাল ৯টায় এজলাসে আসেন। তারা আসন গ্রহণের পর ৯টা ৫ মিনিটে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে তলবের আদেশ আসে।
তাদের বক্তব্যকে বিচার প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মান ও মর্যাদাকে হেয় করার শামিল বিবেচনা করে ১৫ মার্চ হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।
আদেশ দেওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, “দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে অশুভ ও অবমাননাকর বক্তব্যে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা স্তম্ভিত, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।”
এই আদেশের পর আদালত কক্ষে গুঞ্জন ওঠে- রায় হয়তো হচ্ছে না, কারণ তালিকায় নেই। এ সময় মীর কাসেমের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। বেশ কয়েকটি টেলিভিশন ‘রায় হচ্ছে না’ জানিয়ে দিলে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে ওঠে।
এরপর ৯টা ২০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, সম্পূরক কার্যতালিকায় ১ নম্বরে ‘ফুল বেঞ্চ’ রেখে ১ (এ) হিসেবে মীর কাসেমের আপিল মামলা অর্ন্তভুক্ত করতে বলা হয়েছে।
“আমরা রায় ঘোষণা করব, অথচ এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতকে ‘ই’ করে ফেলেছে, যেন শৃঙ্খলা নেই। ইউ আর রিয়েলি টায়ার্ড, বলে দেওয়ার পরও যদি দাড়ি, কমা ঠিক করে দিতে হয়... উফ!”
এরপর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডেকে প্রধান বিচারপতি ১ (এ) হিসেবে মীর কাসেমের আপিল মামলা সম্পূরক তালিকায় যোগ করতে বলেন। কিছুক্ষণ পর এজলাস ত্যাগ করেন বিচারকরা। পরে ৯টা ৪০ মিনিটে সম্পূরক তালিকায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়।
মীর কাসেম আলীর আপিলের রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
মীর কাসেম আলীর আপিলের রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
আপিল বেঞ্চের পাঁচ বিচারক আসন নেওয়ার পর ৯টা ৪০ মিনিটে চারটি বাক্যে রায়ের আদেশ অংশ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।
রায়ে বলা হয়, মীর কাসেমের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ৪, ৬ ও ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
আর ২, ৩, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে আপিল নাকচ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ই বহাল রাখা হয়েছে।
এর মধ্যে ১২ নম্বর অভিযোগে হত্যার দায় থেকে এই জামায়াত নেতা অব্যাহতি পেলেও ১১ নম্বর অভিযোগ সর্বোচ্চ সাজাই বহাল রাখা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায় | অভিযোগ | আপিলের রায় |
খালাস | অভিযোগ ১ | বিবেচিত হয়নি |
২০ বছরের কারাদণ্ড | অভিযোগ ২ | ২০ বছরের কারাদণ্ড বহাল |
৭ বছরের কারাদণ্ড | অভিযোগ ৩ | ৭ বছরের কারাদণ্ড বহাল |
৭ বছরের কারাদণ্ড | অভিযোগ ৪ | খালাস |
খালাস | অভিযোগ ৫ | বিবেচিত হয়নি |
৭ বছরের কারাদণ্ড | অভিযোগ ৬ | খালাস |
৭ বছরের কারাদণ্ড | অভিযোগ ৭ | ৭ বছরের কারাদণ্ড বহাল |
খালাস | অভিযোগ ৮ | বিবেচিত হয়নি |
৭ বছরের কারাদণ্ড | অভিযোগ ৯ | ৭ বছরের কারাদণ্ড বহাল |
৭ বছরের কারাদণ্ড | অভিযোগ ১০ | ৭ বছরের কারাদণ্ড বহাল |
ফাঁসি | অভিযোগ ১১ | মৃত্যুদণ্ড বহাল |
ফাঁসি | অভিযোগ ১২ | খালাস |
খালাস | অভিযোগ ১৩ | বিবেচিত হয়নি |
১০ বছরের কারাদণ্ড | অভিযোগ ১৪ | ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল |
এ মামলার বিচারে রাষ্ট্রপক্ষ ৬৩ বছর বয়সী মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে।
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।
ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর আলাদা ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল সে সময়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “ডালিম হোটেলে ঘটে যাওয়া সবধরনের অপরাধের ব্যাপারে সবকিছুই জানতেন মীর কাসেম। এসব অপরাধে তার ‘কর্তৃত্বপূর্ণ’ অংশগ্রহণও প্রমাণিত। ফলে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪ (২) ধারা অনুযায়ী তিনি ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের’ দোষে দোষী।”
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত হলো।
মীর কাসেম আলী
সেই ডালিম হোটেল
মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস কাসেম আলী রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে অসাধারণ ধূর্ততার স্বাক্ষর রেখে অত্যন্ত দ্রুততায় নিজের ও দলের উন্নতি ঘটিয়েছেন, পরিণত হয়েছেন জামায়াতের আর্থিক মেরুদণ্ডে।
জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এই যাত্রাপথে তিনি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছেন।
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামের তৈয়ব আলীর দ্বিতীয় ছেলে মীর কাসেম আলীর জন্ম ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তার ডাকনাম পিয়ারু হলেও চট্টগ্রামের মানুষ তাকে চিনত মিন্টু নামে।
গত শতকের ষাটের দশকে কাসেম ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থী, ১৯৬৭ সালে ওই স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করেন। বাবা তৈয়ব আলী ছিলেন চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকার সিঅ্যান্ডবি কলোনিতে তারা থাকতেন।
চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর সেখানেই স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন কাসেম, পরের বছর জামায়াতের তখনকার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কলেজ শাখার সভাপতি হন। স্বাধিকারের দাবিতে বাঙালির সংগ্রাম তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সারা দেশে বাঙালি নিধন শুরু করলে স্বাধীনতার লড়াইয়ে অস্ত্র হাতে নেয় এ দেশের মানুষ। ওই বছর ৬ নভেম্বর পর্যন্ত কাসেম চট্টগ্রাম শহর শাখা ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন এবং সেই সূত্রে ছিলেন চট্টগ্রামে আল বদর বাহিনীর নেতা।
৭ নভেম্বর দলে পদোন্নতি পেয়ে তিনি পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন। সে সময় সংগঠনের সভাপতি ছিলেন যুদ্ধাপরাধী আরেক জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসাবে মীর কাসেম চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত হন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তিনি আত্মগোপনে যান। স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ছাত্রসংঘ ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি।
ট্রাইব্যুনালের নথিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে ঢাকার আইডিয়াল কলেজ থেকে বিএ পাস করেন মীর কাসেম।
পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান জামায়াতকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করলে মীর কাসেম তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন।
১৯৮০ সালে কাসেম যখন সরাসরি জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেন, তখন তিনি রাবেতা আলম আল-ইসলামী নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ সমন্বয়ক। বলা হয়, সেই সময় থেকেই তিনি জামায়াতের আর্থিক ভিত্তি মজবুত করতে কাজ করে আসছেন।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন হলে মীর কাসেম প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান হন। দলে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ১৯৮৫ সালে তিনি হন জামায়াতের শুরা সদস্য।
ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মীর কাসেম ছিলেন ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য ।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত মীর কাসেম দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানেরই সংবাদপত্র দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন। ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মীর কাসেম আলী, ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর রায়ের আগে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার পথে।
মীর কাসেম আলী, ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর ট্রাইব্যুনাল থেকে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার পথে।
আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগের ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর দুই পক্ষের করা রিভিউ আবেদন এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
আর সর্বশেষ রায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায়।
শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
আরও প্রতিক্রিয়া