অভিজিৎ হত্যা: খুনি ‘শনাক্তেই’ বছর পার

লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় খুনের পর বছর পেরোলেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়নি; পুলিশের পক্ষ থেকে হত্যায় জড়িত কয়েকজনকে শনাক্তের দাবি করা হলেও তারা এখনও গ্রেপ্তার হয়নি।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবকামাল হোসেন তালুকদার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2016, 04:07 PM
Updated : 25 Feb 2016, 07:31 PM

আলোচিত এই হত্যার তদন্তে অসন্তোষ জানিয়ে অভিজিতের পরিবার বলছে, এটা এত ধীরগতিতে চলছে যে ‘শেলফে’ তুলে রাখার পর্যায়ে এসেছে।

তবে ধীরগতির পক্ষে যুক্তি দিয়েছে তদন্তের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

এ হত্যাকাণ্ডকে ‘সুপরিকল্পিত’ মন্তব্য করে গোয়েন্দাদের মুখপাত্র মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, “শিক্ষিত স্মার্ট ছেলেরা সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটালে সেটি বের করতে একটু সময় লাগে।

“এই হত্যাকাণ্ডে যারা ফিল্ডে জড়িত থাকে তারা ছাড়াও মদদদাতা, কো-অর্ডিনেটর অনেকেই সম্পৃক্ত থাকে। কেউ অনুপ্রেরণা দিয়ে, কেউ অর্থ দিয়ে, কেউবা সাহস দিয়ে, কেউ প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজে সহায়তা করে থাকে।”

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিৎ রায় ছিলেন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা। গত বছর বইমেলা চলাকালে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে দেশে ফিরে ২৬ ফেব্রুয়ারি খুন হন তিনি।

বইমেলা থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন অভিজিৎ। তার স্ত্রী বন্যাও সন্ত্রাসীর চাপাতির আঘাতে আঙুল হারান।

লেখালেখির কারণে আগে থেকে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হুমকির মুখে ছিলেন অভিজিৎ। পুলিশের তদন্তও জঙ্গিদের ধরেই এগোচ্ছে।

এক বছর বাদে তদন্তের অগ্রগতি হিসেবে ঘটনায় জড়িত কয়েকজনকে শনাক্ত করার কথা বলেছেন মনিরুল।

“অভিজিৎ হত্যায় সরাসরি ঘটনাস্থল ও ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিল এমন তিনজনকে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। এর বাইরে ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিল বা কোনোভাবে ছিল এমন ৬/৭ জনকে শনাক্ত করেছি।

“ঠিক ঘটনাস্থলে না থাকলেও বইমেলা বা বাংলা একাডেমি ও তার আশপাশে অবস্থান করেছিল। তাদের বিষয়ে ‘ডমুমেন্টরি এভিডেন্স’ হাতে রয়েছে।”

টিএসসির সামনের এই জায়গায় হামলার শিকার হন অভিজিৎ

তদন্তে এফবিআই কর্মকর্তারা

এছাড়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটজনকে গ্রেপ্তারের কথাও বলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল।

গ্রেপ্তারদের মধ্যে ইন্টারনেটে উগ্রবাদের প্রচারক ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী এবং সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস খুনের আসামি মান্নান ইয়াহিয়া ওরফে মান্নান রাহীকে অভিজিৎ হত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ্ আনা হয়েছে।

গ্রেপ্তার অন্য ছয়জন ব্রিটিশ নাগরিক তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলী, আমিনুল মল্লিক, জুলহাস বিশ্বাস, আবুল বাশার ও জাফরান হাসানের মধ্যে কেউ সরাসরি অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল বলে সন্দেহ পুলিশের।

“যে ফেইসগুলো শনাক্ত করেছি তার ভেতর তারা থাকলেও থাকতে পারে। সেজন্য যেসব আলামত সংগ্রহ করেছিলাম, যা ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে তার ফলাফল পেলে এদের ডিএনএ স্যাম্পলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে,” বলেন মনিরুল।

হত্যাকাণ্ড তদন্তে পুলিশকে সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই; ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন আলামত তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এর প্রতিবেদন এখনও পাওয়া না গেলেও সেখানে কিছু ডিএনএ নমুনা পাওয়া গেছে বলে দুই সপ্তাহ আগে জানিয়েছিলেন মনিরুল।

গোয়েন্দারা অভিজিৎ হত্যায় যাদের শনাক্ত করেছে তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য বলে জানান তিনি।

‘শিগগিরই’ মামলার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসবে বলে আশাবাদী পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “গ্রেপ্তারদের বাইরে যাদের শনাক্ত করেছি তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। কেবল ডিএনএ রিপোর্ট বা এফবিআইয়ের রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি সেটি নয়।

“আশাবাদী খুব শিগগিরই এই মামলাসহ ব্লগার, প্রকাশক হত্যার যেগুলো ডিটেক্ট হয় নাই, সেসব মামলার একটার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারব।”

ছেলের কফিনের সামনে বাবা অজয় রায়

এফবিআইয়ের পরীক্ষার প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, “তারা শুধু একটা ছুতোই দেয় যে, এফবিআইয়ের ডিএনএ প্রোফাইলের প্রতিবেদন পায়নি।

“এফবিআইয়ের ডিএনএ প্রোফাইলের দরকার কী? নিজেদের ল্যাবরেটরিতে প্রোগ্রেস করতে থাক, এফবিআইয়ের প্রতিবেদন এলে তা মিলিয়ে দেখবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, “এফবিআইয়ের তো হাজার কাজ। অভিজিৎ হত্যা তাদের কাছে এত বড় না যে, তারা টপ প্রায়োরিটি দেবে। তারা ঠিকমতো কাজ করবে, সময় হলে পাঠাবে।”

তদন্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এই হত্যা তদন্তে অগ্রগতি নিয়ে পারিবারিকভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট নই। এত ধীরগতিতে তদন্ত চলছে যে, এটা অলমোস্ট শেলফে তুলে রাখার পর্যায়ে এসেছে। এজন্য আমি মনে করি না যে, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচার খুব অদূর ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে।”

“বাংলাদেশে বিচারহীনতার কালচার শুরু হয়েছে। যে কাউকে হত্যা করে পার পাওয়া যায় এবং সেটা আসলেই দেখা যাচ্ছে।”

পুলিশ হত্যাকারীদের ধরতে চায় কি না তা নিয়েই সন্দিহান অধ্যাপক অজয় রায়।

“তোমাদের কাছে যদি উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ থাকে যে তারা হত্যায় জড়িত, ওই প্রকৃত হত্যাকারীদের যদি শনাক্ত করে থাক, ওরা (ডিবি) বলছে- শনাক্ত করা হয়েছে এখন নজরদারিতে আছে, তাহলে তোমরা ইন অ্যাবসেনশিয়া তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পার।

“জানি না তাদের মনে কী আছে। তারা ধরতেও চায় কি না।”

গত বছর অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর আরও কয়েকজন ব্লগার খুন হন। এরপর অভিজিতের বইয়ের দুই প্রকাশক হামলার শিকার হন। এর মধ্যে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপন মারা যান।