রাজধানীর বায়ু দূষণের এই বিবরণ পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘নিমর্ল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট-সিএএসই) প্রকল্পের পরিচালক এস এম মঞ্জুরুল হান্নান খানের।
কেবল ঢাকা নয়, পাশের দুই সিটি করপোরেশন গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহীতে শীত মৌসুমের অধিকাংশ দিনে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা থাকে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ মাত্রায়।
মঞ্জুরুল বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে শীত মৌসুমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি। তবে বর্ষায় অবস্থা তুলনামূলকভাবে ‘ভালো’ থাকে।
বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ মাইক্রোমিটার ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা।
বাংলাদেশের সিটি করপোরেশন এলাকার ১১টি স্থানের বাতাসে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা হচ্ছে ‘সিএএসই’ প্রকল্পের মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ‘ভালো’ বলা যায়।
এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে ‘মধ্যম’ মানের এবং ১০১-১৫০ হলে ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১-৩০০ হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১-৫০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়।
ওই দিন কেবল সিলেট ছাড়া দেশের সব বড় শহরের বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার মাত্রাই ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে ছিল।
পরদিন ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা ছিল ৩৩৯ পিপিএম, গাজীপুরে ৩৭২ পিপিএম, চট্টগ্রামে ২৫৮ পিপিএম, সিলেটে ১৯৪ পিপিএম, রাজশাহীতে ৩৩৫ পিপিএম এবং বরিশালে ৪০২ পিপিএম।
ওই দিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার সংসদ ভবন এলাকার বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা ছিল ৩২৯ পিপিএম, ফার্মগেইটে ৩২১ পিপিএম, মিরপুরের দারুস সালামে ৩৬৬ পিপিএম। আর চট্টগ্রামের টিভি সেন্টার এলাকায় ২৩৪ পিপিএম ও আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকায় ২৮১ পিপিএম।
মাঝেমধ্যে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও শীত মৌসুমের শেষভাগে এসে ১৮ জানুয়ারিতেও বড় শহরগুলোর বাতাস ছিল ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’।
অবশ্য গত বছরের ২৬ জুলাইয়ের পরিস্থিতি অনেকটা ভালো ছিল। ভরা বর্ষার সেই দিনে ঢাকার সংসদ ভবন এলাকার বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা ছিল ৮ পিপিএম, ফার্মগেইটে ৩৩ পিপিএম, মিরপুরের দারুস সালামে ১৮ পিপিএম, গাজীপুরে ১১ পিপিএম, নারায়ণগঞ্জে ২৫ পিপিএম, চট্টগ্রামের টিভি সেন্টার এলাকায় ২২ পিপিএম ও আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকায় ৩০ পিপিএম, সিলেটে ৩৬ পিপিএম, খুলনায় ১৬ পিপিএম এবং বরিশালে ৪৯ পিপিএম।
বাতাসে বস্তুকণা ছাড়াও কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ওজোন, সালফার ডাই অক্সাইডের মাত্রাও পরিমাপ করা হচ্ছে সিএএসই প্রকল্পে।
প্রকল্পের ডেটা কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স অফিসার সাবেরা নাসরিন বলেন, গত ৫ বছর ধরেই তারা বায়ুর মান নিয়মিত পরিমাপ করছেন।
“বর্ষা মৌসুম ভালো গেলেও শীত মৌসুমে সব সময়ই মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাচ্ছি। দিনের চেয়ে রাতের বাতাসের মান খারাপ থাকে। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সব শহরেই বায়ুতে অতি ক্ষতিকর মাত্রায় বস্তুকণা পাওয়া যাচ্ছে।”
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছাকাছি থাকা প্রবীণ হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুবা আক্তার আরজু জানান, তাদের কাছে যে প্রবীণ রোগীরা শীত মৌসুমে আসেন, তাদের অধিকাংশের সমস্যা শ্বাসকষ্টজনিত।
“হাঁচি-কাশি নিয়ে রোগী আসছে হরদম। কমন কোল্ড, সাইনোসাইটিস, গলাব্যথা, অ্যাজমা-অ্যালার্জি, শ্বাসতন্ত্রে ক্ষতসহ নানা ধরনের রোগী আসছে আমাদের এখানে। বায়ু দূষণ এর বড় কারণ।”
তিনি বলেন, বয়স্কদের মতো শিশুরাও বায়ু দূষণের কারণে নানা অসুস্থতায় ভুগছে। ‘সিজনাল ডাস্টের’ কারণে শীত মৌসুমে এ ধরনের রোগীই বেশি আসে।
কেবল ধুলা নয়, ঢাকার রাস্তার সচল গাড়ির ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন গ্যাস সম্পূর্ণ পোড়াতে পারে না বলে মিথেন থেকে বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড সৃষ্টি হচ্ছে।
এছাড়া সালফার ও সীসাযুক্ত পেট্রোল ব্যবহার এবং জ্বালানি তেলে ভেজালের কারণে গাড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার-ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন উপাদান ও সীসার মতো ভারী কণা বাতাসকে দূষিত করছে। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য, উড়ন্ত ছাই, ধোঁয়া, অ্যারোসল ও ফোমের কারণেও বায়ু দূষণ ঘটছে।
সরাসরি বিষাক্ত উপাদানের প্রতিক্রিয়া ছাড়াও দূষণের কারণে বাতাসে প্রকৃত উপাদানের পরিমাণে তারতম্য ঘটে, যা ফুসফুসের কাজ ও রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটায়।
অধিদপ্তরের সহকারী প্রোগ্রামার ফরহাদ বিন বশর চৌধুরী বলেন, “আমরা কয়েকদিন আগেও অভিযান পরিচালনা করেছি, এখন তা নিয়মিত চলছে। সর্বশেষ অভিযানে ৩০টি গাড়ির ক্ষতির ধোঁয়া পরীক্ষা করে ১৫টিকে জরিমানাসহ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক আবদুল ফাত্তাহ বলেন, কেবল মানুষ নয়, উদ্ভিদও বায়ু দূষণের শিকার হচ্ছে। যার প্রভাব আবার মানুষের ওপরই পড়ছে।
চিকিৎসক মাহবুবা আক্তার আরজু বলেন, দূষণের ক্ষতি কমাতে রাস্তায় ‘কাপড়ের মাস্ক’ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাস্তায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
“তবে দূষণ কমাতে পুরনো যানবাহন বন্ধের পাশাপাশি ইটভাটার দূষণ কমাতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ হারুন জানান, বাংলামোটর, জিরো পয়েন্ট, নগর ভবন, মালিবাগ মোড়, মগবাজার, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ আরও কিছু ভিআইপি এলাকায় পানি ছিটানো হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিবেশ জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তারেক বিন ইউসুফ বলেন, “আমাদের বিভাগের কার্যতালিকায় ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মহল থেকেও এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি।”