শত বছর পর ‘মসলিনের দেখা’

মিহি সুতায় বোনা সূক্ষ্ম যে কাপড়ের দুনিয়াজোড়া খ্যাতির কথা আজকের বাঙালি জেনেছে ইতিহাসের পাতা থেকে, সেই মসলিন আবার ঢাকায় ফিরছে! 

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2016, 04:11 PM
Updated : 6 Feb 2016, 03:10 AM

রূপগঞ্জের এক কারিগরের বানানো ৩০০ কাউন্টের সুতার (৩০০ মিটার সুতার ওজন ১ গ্রাম) দুটি শাড়ি বৃহস্পতিবার জাতীয় যাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়েছে। বারো হাত ও সাড়ে বারো হাত দৈর্ঘ্যের শাড়ি দুটির বেড় ৪৭ ইঞ্চি।

গবেষকরা বলছেন, আড়াইশ কাউন্টের চেয়ে মিহি সাদা সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হতো শত বছর আগে। রাজ পরিবারের মেয়েদের পছন্দের শীর্ষে থাকা এই শাড়ি বোনা হতো কার্পাসের সুতায়। এজন্য এক সময় বৃহত্তর ঢাকার মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীর সংলগ্ন অঞ্চলে হতো ফুটি কার্পাসের চাষ। সেইই সুতা তৈরি হতো নদীতে নৌকায় বসে, উপযোগী আর্দ্র পরিবেশে।

ব্রিটিশ শাসনামলে কল-কারখানা থেকে সাশ্রয়ী কাপড় আসায় একসময় হারিয়ে যায় দীর্ঘ সময় নিয়ে মসলিন তৈরির তাঁত ও সুতা। সেই সুতা ফিরিয়ে আনতে সরকার গত বছর ১২৪০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে, যার কাজ শুরু হবে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে।

জাতীয় জাদুঘরের নলীনিকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ‘মসলিন রিভাইভাল’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ওই দুটি শাড়ির সঙ্গে রাখা হয়েছে একটি তুলা গাছ। এই গাছ থেকেই মসলিন তুলা আসার কথা শুনিয়েছেন আয়োজকরা।

জাতীয় জাদুঘরে মিহি সুতার ‘মসলিন’ দেখছেন অতিথিরা।

প্রদর্শনী দেখছেন অর্থমন্ত্রী, সংস্কৃতিমন্ত্রী

জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য আনা কয়েকটি পুরাতন মসলিন কাপড়ও প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। নতুন করে মিহি সুতায় এই শাড়ি বোনার অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন কারিগর আল আমিন।

ছোটবেলা থেকে জামদানি শাড়ি তৈরির পেশায় থাকা আল আমিন জানান, বছর দেড়েক আগে নওয়াপাড়া জামদানি হাটে দৃকের প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয় তার।

“তিনি আমাকে একটা সুতা দেখিয়ে বলেন, এটা দিয়ে কাপড় বানাতে পারবা? এত চিকন সুতা দেখে আমি ভয় পাইয়া যাই। পরে তিনি আমার বাড়ি চলে আসেন।  কথা বলতে মাটিতে বসে যান। এটা দেখে আমি নিজেরে আর মানা করতে পারলাম না। সুতাটা নিলাম।

“প্রথম এক দেড় মাস কাজই করতে পারিনি। সুতা নষ্ট হয়ে যেত। এরপর ছমাস লাগে প্রথম শাড়িটা তৈরি করতে। এই সময় সবাই আমাকে বলছে, কাজটা ছেড়ে দিতে।”

অনুষ্ঠানে সেসব দিনের কথা জানালেন আল আমিনের স্ত্রী ফাতেমা বেগমও।

“হেয় সারাদিন কী যে করত! টেনশন করত। তখন আমি বলছি, এত টেনশন কইরা মাথা নষ্ট করার দরকার নাই। তোমার কিছু হয়া গেলে আমরা কী করুম? যেইডা পার, হেইডাই কর। এইডা করার দরকার নাই।”

মিহি সুতার কাপড় বুনছেন কারিগর।

তারপরও চেষ্টা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেছেন আল আমিন, এখন তিনি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।

“সরকার আরও চিকন সুতা দিলে আমি আরও মিহি মসলিন বানাতে পারব,” বলেন এই কারিগর।

মসলিন গবেষক সাইফুল জানান, ৭০০ কাউন্ট পর্যন্ত মিহি সুতায় বোনা মসলিন দেখেছেন তিনি।

“ওইটার সুতা চুলের থেকেও বেশি সূক্ষ্ম।”

পুরো একটি মসলিন একটি ম্যাচের বাক্সে ভরতে পারার যে কথা প্রচলিত আছে সেটা ৮০০ কাউন্টের সুতায় বোনা বলে জানান তিনি।

ইতিহাসের বইয়ে সর্বোচ্চ ১২০০ কাউন্টের সুতার মসলিনের কথা আছে জানিয়ে এই গবেষক বলেন, “জঙ্গলবাড়ির কাছে কিশোরগঞ্জের একটি গ্রামে সেটা বানিয়েছিল। আমি সেখানে গিয়েছি। ওইখানে ১২০০ কাউন্ট কী কোনো তাঁতই নাই আজ। ১৮৬২ সালেও এটা ছিল।

“সেই মসলিন কতোটা স্বচ্ছ হতে পারে আমি এটা কল্পনাও করতে পারি না। ৭০০ কাউন্টের কাপড়ের সাত পাল্লা রাখলেও একটা বই পড়তে পারবেন।”

সাইফুল বলেন, “মসলিন নানা ধরনের ছিল। একটি ধরন ছিল জামদানি, যেটা ফুলওয়ালা। আরেকটা ছিল মসৃণ। আরেকটি ধরন ছিল ডুরিয়া, যেটাতে দাগ আছে। আরেকটি ধরনের রং ছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ ধরনের মসলিন ছিল।”

বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে মসলিন সংরক্ষিত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি যখন বিলাতে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট জাদুঘরে দেখলাম, যার কিউরেটর এখানে এসেছেন। আমি উনার ওখানে প্রায় ৭০০-৮০০ দেখেছি। আরেকটা মিউজিয়ামে প্রায় দেড়শ দেখেছি। তাদের ন্যাশনাল ট্রাস্ট হেরিটেজে দেখেছি প্রায় ১২০০ রয়েছে।”

বিদেশ থেকে আনা মসলিন কাপড় রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে।

‘মসলিন রিভাইভাল’ প্রদর্শনীতে দুই মন্ত্রী

বিকালে যাদুঘরে প্রায় মাসব্যাপী এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ১৯৫১ সালে বলধা গার্ডেন যাদুঘরে তিনি এই শাড়ি প্রথম দেখেন।

“যে তুলা থেকে এই শাড়ি তৈরি করা হতো সেই তুলাই এখন আর নেই। সম্রাট শাহজাহানের মেয়ে জাহানারা বাঙলায় এসে মসলিন নিয়ে যান। এটা এতো মিহি ছিল যে, সাতবার পেঁচিয়ে মসলিন পরে বাবার কাছে যাওয়ার পরে শাহজাহান বলেছিলেন, তুমি ‘নেকেড’ হয়ে কেন আমার সামনে আসলে?”

মসলিনের কারিগর হারিয়ে যাওয়ার পিছনে ব্রিটিশদের দায়ী করেন মুহিত।

“ম্যানচেস্টারের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির যখন বাজার প্রয়োজন হয়েছে তখন আমাদের এরকম বহু লোককে পাওয়া গেছে যাদের আঙুল কেটে ফেলা হয়েছে। এই সমালোচনা আমাকে করতেই হবে।”

অন্যদের মধ্যে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সংস্কৃতি সচিব আখতারি মমতাজ, ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তামারা আবেদ, যুক্তরাজ্যের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামের সিনিয়র কিউরেটর রোজম্যারি ক্রিল, দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।