চা বাগান ছেড়ে পতিত অন্য জমি নেওয়ার পরামর্শ শ্রমিকদের

চান্দপুর-বেগমখাঁন চা বাগানের জমি বাদ দিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে পতিত অন্য জমি নেওয়ার পরামর্শ সরকারকে দিয়েছেন শ্রমিকরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2016, 06:03 PM
Updated : 21 Jan 2016, 06:13 PM

‘চান্দপুর-বেগমখাঁন ভূমি রক্ষা কমিটি’র যুগ্ম-আহ্বায়ক কাঞ্চন পাত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চুনারুঘাটেই সাড়ে ১৬ হাজার একর পতিত জমি আছে। কেলেঙ্গা এলাকার বিশাল এলাকাও পতিত ও অনাবাদী। সেখানে নিয়ে গেলেই চা-শ্রমিকদের উচ্ছেদ হতে হবে না।”

অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে সরকারের জমি নেওয়া পরিকল্পনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ঢাকায় কর্মসূচি পালনে এসে একথা বলেন তিনি।

‘কৃষি জমিতে কলকারখানা হবে না’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য তুলে ধরে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কর্মসূচিতে বলেন, “চুনারুঘাটেই হাজার একর খাস জমি আছে, আপনারা সেখানে এ অঞ্চল করুন। আপনারা যদি সেই জমি খুঁজে না পান, তাহলে আমাদের বলুন, আমরা খুঁজে দেব।”

কারওয়ান বাজারে বেজা কার্যালয়ের সামনে অঞ্চলটি অন্যত্র সরানোর দাবিতে এক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে ওই চা বাগানের প্রায় ১০০ শ্রমিক অংশ নেন।

তাদেরই একজন সাত সদস্যের পরিবারের শঙ্কর মিশ্র। ভাইয়ের চাকরির সুবাদে চান্দপুর-বেগমখাঁন চা বাগানের ভেতরেই বসবাস তাদের।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ছোট ভাইয়ের দৈনিক ৬৯ টাকা মজুরির বাইরে পরিবারের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ১২৬ শতক আবাদী জমি। চার পুরুষ ধরে ওই জমি চাষাবাদ করেন তারা।

“ঝোপ-ঝাড় আর জঙ্গল কেটে চার পুরুষ ধরে আমরা বাস করছি। অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে তো সবই শেষ। আমরা মা-মাটি ছাড়ব কীভাবে?”

ছবি: ফায়হাম ইবনে শরীফ

সরকার পরিকল্পিত ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে একটি হচ্ছে চুনারুঘাটের চান্দপুরে। এজন্য চান্দপুর-বেগমখাঁন চা বাগান এলাকার ৫১১ একর জমি বেজাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ডানকান বাদার্সকে (যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্যামেলিয়া পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বাংলাদেশে এই নামে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে) দেওয়া লিজ বাতিল করে এই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।

প্রায় ৪ হাজার একর বাগানের ৯৫১ একরে কৃষিকাজ করে আসছে বাগানের শ্রমিক ও তাদের পরিবার। অর্থনেতিক অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৫১১.৮৩ একর জমি ‘ক্ষেতল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত ওই ৯৫১ একর জমির অংশ।

শঙ্কর মিশ্রের সঙ্গে ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচিতে আসা রিপন গোস্বামী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জঙ্গল কেটে প্রায় দেড়শ বছর আগে পূর্বপুরুষরা আবাদী জমি তৈরি করেন। এখন তাদের জমির পরিমাণ ৫৬ শতক। জমিতে বছরে দুইবার ধান ও একবার রবিশস্য হয়।

৪০ বছর বয়সী রিপন ধরা গলায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জঙ্গল সাফ করে দেড়শ বছর ধরে খাস জমি চাষাবাদ করে আমরা এখানে আছি। এখন আমাদের ছাড়তে বলা হচ্ছে। আমরা তাহলে কোথায় যাব?”

“কিছু করতে হলে সরকার অন্য কোথাও করুক, আমাদের ভূমির উপরে কেন?”

চা-বাগানের ওই জায়গাটি বাদ দিয়ে বিকল্প জায়গায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করার দাবি জানিয়ে আসছে ‘চান্দপুর-বেগমখাঁন ভূমি রক্ষা কমিটি’।

ছবি: ফায়হাম ইবনে শরীফ

অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে সেখানকার চা শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির কথা বেজা’র পক্ষ থেকে বলা হলেও ‘শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে’ তা থেকে ছিটকে পড়ার শঙ্কা ছড়িয়েছে শ্রমিকদের মাঝে।

কমিটির নেতা কাঞ্চন পাত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক জায়গায় এই রকম আশ্বাস দিয়ে পালন করা হয়নি। আবার চা শ্রমিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিবেচনায় এই চাকরি কোনোভাবে মিলবে না।”

ওই এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকে তা বাতিলের দাবিতে প্রায় আট হাজার সদস্যের এসব পরিবার নিজেদের ‘দখলি জমি বাঁচানোর’ আন্দোলনে আছে।

তাদের নিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকায় কর্মসূচি পালন করে সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, ন্যাপ, নাগরিক ঐক্য।

অবস্থান কর্মসূচি থেকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিলে ১০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

সিপিবির সভাপতি সেলিম বলেন, “দাবি মানা না হলে আমাদের অবস্থান ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বেজা কার্যালয়ের সামনে সীমিত থাকবে না। সারা দেশের চা-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তখন জাতীয় সংসদ অভিমুখে অভিযাত্রা করব।”

তিনি বলেন, “৬০ বছর ধরে কেউ অনাবাদি বা খাসজমি চাষ করলে সেটা তার মালিকানা হয়ে যায়। অথচ এক্ষেত্রে ১৫০ বছরের আবাদি জমিকে পতিত ও খাস জমি হিসেবে দেখানো হয়েছে।”

এক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে চা শ্রমিক কনকলতা রাজবংশী সরকারকে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “রক্ত দিব, জীবন দিব, আমাদের ধান্য জমিতে কোনো জোন হতে দেব না।”

কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, সিপিবির সাজ্জাদ জহির চন্দন, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের আবুল হাসান, হবিগঞ্জের চা শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক মাহমুদা খাঁ, মোহন রবিদাস ও স্বপন সাঁওতাল বক্তব্য দেন।