সোমবার ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার এই শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর এ ধরনের ঘটনায় আহত হয়ে ২৯ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ৩২ জন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেছেন।
ঢাকায় আহতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে মেডিকেল ফাঁড়ি পুলিশের পরিদর্শক মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক জানান।
সকালে পূর্ব জুরাইনের এক বাসা থেকে দৌঁড়ে নামতে গিয়ে আতিকুর রহমান নামে ২৩ বছর বয়সী এক যুবকের মৃত্যু হয়। তিনি নিজে পড়ালেখা করার পাশাপাশি টিউশনি করে খরচ চালাতেন। তবে তিনি কোথায় পড়তেন তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
“তার শরীরের কোথায় কোন জখমের চিহ্ন নেই। আতঙ্কে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে,” বলেন মোজাম্মেল।
একইভাবে মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রধান বাবুর্চি খলিলুর রহমান ও লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ঘোনাবাড়ীর মুদি দোকানি নূর ইসলাম কদু মিয়া (৬০), জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার গাওকুড়া গ্রামের দর্জি সোনা মিয়া (৩৮) ও পঞ্চগড় শহরে তাহমিনা বেগম (৫৫) নামে এ নারী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর প্রতিনিধি জানান, ভূমিকম্পের সময় মারা যাওয়া সোনা মিয়া গাওকুড়া গ্রামের বছির শেখের ছেলে।
তার বড় ভাই মৃণাল শেখ বলেন, “আমার ভাই মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে ছিল। ভূমিকম্পের সময় ভয়ে তার হার্ট অ্যাটাক হয়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা গেছে।”
পঞ্চগড়ে মারা যাওয়া তহমিনা বেগমের বাড়ি শহরের পূর্ব জালাশী মহল্লায় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি জানান।
তহমিনা বেগমের ছেলে সোহেল বলেন, “ভূমিকম্পের সময় মা ঘরে শুয়ে ছিলেন। ঘরে ঝাঁকুনি হলে ভয় পেয়ে চিৎকার ও কান্নাকাটি করতে করতে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যান।
“সকালে স্থানীয় এক চিকিৎসককে এনে দেখালে তিনি হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মা মারা গেছেন বলে চিকিৎসকরা জানান।”
পঞ্চগড় সদর আধুনিক হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মাহবুব-উল-আলম বলেন, আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাহমিনা। হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়।
“সম্ভবত আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, মুজিবুর রহমান হলের প্রধান বাবুর্চি খলিলুর রহমান পরিবার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মেহেরচণ্ডি এলাকায় থাকতেন। তার গ্রামের বাসা কুমিল্লা জেলায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মোহা. আশরাফ উজ জামান বলেন, সকালে ভূমিকম্পের সময় খলিল আতঙ্কিত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় তিনি মেয়ে এবং কয়েকজন নিকট আত্মীয়কে টেলিফোনও করেন।
“এর কয়েক মিনিট পর তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।”
মতিহার থানার ওসি হুমায়ূন কবির বলেন, ভূমিকম্পের পর খলিলুর রহমানের মৃত্যুর বিষয়টি তারাও জানতে পেরেছেন।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, পাটগ্রামের ঘোনাবাড়ী এলাকায় আতঙ্কিত হয়ে মৃত মুদি দোকানি নূর ইসলাম কদুর বাজার এলাকার নজর উদ্দিনের ছেলে।
পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে পাটগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহ জামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভূমিকম্পের সময় নূর ইসলাম ঘুম থেকে উঠে আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এক পর্যায়ে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যান, সেখানেই তার মৃত্যু হয়।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একজন দায়িত্বরত কর্মী জানান, সকাল থেকে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছেন।
এদের মধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের এক শিক্ষার্থী পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। এছাড়া মহসিন ও কবি জসিম উদ্দীন হলের দোতলা থেকেও পাঁচজনের লাফিয়ে পড়ে আহত হওয়ার খবর দিয়েছে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম।
মেডিকেল ফাঁড়ির পরিদর্শক মোজাম্মেল বলেন, “কেউ দোতলা থেকে, কেউ তিনতলা থেকে লাফিয়ে, কেউবা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নামার চেষ্টার সময় আহত হয়েছেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমজাদ আলী ১৬ জনকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
১২ জনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল ও মেডিকেল টিম। আর বাকি চারজনকে বন্ধু সহপাঠীরা হাসপাতালে নিয়ে যান।
হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের ইনচার্জ আবদুল বাতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিকিৎসা নিতে যারা এসেছেন, তাদের মধ্যে তিনজন ভর্তি আছেন। তাদের অবস্থা গুরুতর।”
এরা হলেন- পুলিশ সদর দপ্তরের কনস্টেবল মো. সোহান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র ইয়াসিন আরাফাত ও ইকবাল।
বাতেন জানান, ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে দুইতলা থেকে লাফিয়ে পড়ায় কনস্টেবল সোহানের দুই পা ভেঙে গেছে।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র ইয়াসিন আরাফাত বুকে ব্যাথা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার বন্ধু সুমন। ইয়াসিন ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
শহিদুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ইকবালের অবস্থা গুরুতর বললেও তিনি কোথায় আঘাত পেয়েছেন তা জানাতে পারেননি ঢাকা মেডিকেলের কর্মী বাতেন।
আতঙ্কে হুড়োহুড়িতে আহত হয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছেন ৩২ জন।তাদের কারও অবস্থা গুরুতর নয় বলে জানিয়েছেন মেডিকেলের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক দেবাশিষ সিনহা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসের সিলেট প্রতিনিধিকে তিনি জানান, ভোরে ভূমিকম্পের পর সাড়ে ৫টার দিকে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসতে শুরু করেন স্থানীয়রা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সকালে এই ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ছিল মনিপুরের ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার পশ্চিম উত্তর-পশ্চিম এবং ঢাকা থেকে ৩৫২ কিলোমিটার পূর্ব উত্তর-পূর্বে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি।
ঢাকাসহ সারা দেশেই এ ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার খবর দিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধিরা। শীতের ভোরে আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
ভূমিকম্পের সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে পুরান ঢাকা মিটফোর্ড এলাকার বাসিন্দা নওয়াব হোসেন বলেন, “পুরো ভবন কাঁপছিল। জানালার থাইগ্লাসগুলো ঝনঝন আওয়াজ করছিল।”
এই পরিস্থিতিতে অন্য অনেকের মতো তিনিও স্ত্রী সন্তান নিয়ে চারতলার বাসা থেকে নিচে নেমে আসেন বলে জানান হোসেন।
শাহাদাত হোসেন নামে আরেকজন জানান, দোতলার বাসায় জানালায় আওয়াজ শুনে তিনি ভেবেছিলেন চোর এসেছে। পরে ভূমিকম্পের বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেন।
ভূমিকম্পের আরও খবর