পৌর ভোট: অভিযোগ উঠছে, সত্যতা ‘পাচ্ছে না’ ইসি

পৌরসভা নির্বাচনে বিধি ভঙ্গের একের পর এক অভিযোগ উঠলেও মাঠ পর্যায় থেকে আসা প্রতিবেদনে তার ‘সত্যতা’ না মেলায় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Dec 2015, 05:49 PM
Updated : 24 Dec 2015, 09:42 AM

বিধি ভঙ্গের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তাদের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে ইসি। তবে তা কার্যকর ফল দেবে না বলে আগেই মন্তব্য করেছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন।

আগামী ৩০ নভেম্বর যে ২৩৩ পৌরসভায় ভোট হবে, তার তিন-চতুর্থাংশে সরকারি কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। বাকিগুলোতে এই দায়িত্বে রয়েছেন ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা।  

দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে ‘একতরফা বিজয়’ নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চেষ্টা চালাচ্ছে বলে বিএনপির অভিযোগ।

সংসদ নির্বাচন বর্জন করে স্থানীয় নির্বাচনে আসা এই দলটির আরও অভিযোগ, মন্ত্রী-এমপিরা একের পর এক বিধি লঙ্ঘন করলেও সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ ইসি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্তত ৭০টি পৌরসভায় বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে মাঠ কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।

“এর মধ্যে ১৮টির মতো প্রতিবেদন পেয়েছি আমরা। অধিকাংশই বলেছে, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি,” বলেন অভিযোগ তদারকিতে গঠিত ইসির কমিটির সভাপতি রকিব উদ্দিন মন্ডল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাঠ পর্যায় থেকে আসা ওই সব প্রতিবেদনে রিটার্নিং কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিধি ভঙ্গের ঘটনাগুলোকে ‘অতিরঞ্জিত’ বলেছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরই দায় দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, “যতগুলো ঘটনা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, তার সাত-আট ভাগের একভাগ উত্তর আসছে। কেউ কেউ জানাচ্ছে, তারা অভিযোগের সত্যতা ‍খুঁজে পাচ্ছে না।

“আমি কিছু প্রতিবেদন দেখেছি, সেখানে অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই এমনটা বলা হয়েছে। অন্যরাও বলছে, এ ধরনের কিছু ঘটছে না। তাদেরকে বলেছি- কিছু না থাকলে ‘NILL’ লিখে হলেও পাঠাতে হবে।”

তবে অধিকাংশ রিটার্নিং কর্মকর্তা সরকারি কর্মকর্তা হওয়াকে সমস্যা মনে করছেন না সিইসি। পৌরসভার মতো স্থানীয় নির্বাচনে বরাবরই এভাবেই কাজ চালানো হয় বলে তার মত। আর সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা অধিকাংশই ইসির কর্মকর্তা বলে জানান তিনি।

সিইসি বলেন, “মাঠে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেমেছে। তারা কোনো দল দেখছে না, তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে; আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-স্বতন্ত্র সবাইকে জরিমানা করছে।

“অনেক অ্যাকশন নিচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা জরিমানা করছে।”

অভিযোগ উঠার পর বরগুনায় রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ সুপারসহ ৫ জনকে শো-কজ; ঝালকাঠি, বরিশাল ও জামালপুরের এক রিটার্নিং কর্মকর্তা, তিন ওসিকে প্রত্যাহারের কথাও বলেন তিনি।

সিইসি বলেন, “ইতোমধ্যে কয়েকজনকে বদলে দিয়েছি। আমরা সব সময় খেয়াল রাখছি, অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, যাচাই-বাছাই করে অ্যাকশন নিচ্ছি, সমস্যা মনে হলেই বদলে দেব।”

সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ (ফাইল ছবি)

এবার ভোটের আয়োজন শুরুর পরপরই বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে সিইসি বলেছিলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে, তাদের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

তার প্রতিক্রিয়ায় সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল বলেছিলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহসী হবে না। এক্ষেত্রে তাদের উপর দায়িত্ব দেওয়া ইসির দায় এড়ানোর চেষ্টা।   

এরপর বেশ কয়েকটি ঘটনা গণমাধ্যমে এলেও তাতে শুধু শো-কজ করেই ইসি দায়িত্ব এড়িয়েছে বলে বিএনপির অভিযোগ। আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ইসিকে বলেন ‘মেরুদণ্ডহীন’।

এসব অভিযোগের মুখে বুধবার নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও নির্ভরতা দেখান সেই রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উপরই।

“এখন সরাসরি রিটার্নিং অফিসারকে বলেছি, ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তারা সরাসরি অ্যাকশন নেবে।”

নোয়াখালীর চাটখিলে বিএনপি নেতার প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগ ইসির সচিবালয় থেকে তদন্ত করলেও তার সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন এসেছে।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিধি ভঙ্গ আর হামলা-সংঘর্ষের খবরের পেপার কাটিং করেন তারা। এরপর তা ফাইল করে সংশ্লিষ্টদের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। তা দেখে চিঠি পাঠানো হয়। 

এই প্রক্রিয়ায়ও দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির এক কর্মকর্তা।  

“প্রতিদিনের বিধি লঙ্ঘনের সঙ্গে সঙ্গে ‘অ্যাকশন’ হচ্ছে না, তিন দিন পর ইসি চিঠি পাঠায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কত দিনের মধ্যে, কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা পাঠাবে কী পাঠাবে না, চিঠিতে তারও কোনো নির্দেশনাও থাকে না।”

“সর্বশেষ ১৭ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মঙ্গলবার চিঠি পাঠানো হল। এমন অবস্থা চলতে থাকলে কী অবস্থা হয়, তা তো বুঝতেই পারেন,” বলেন উপ সচিব পর্যায়ের এই কর্মকর্তা।

১৮টি অভিযোগের প্রতিবেদন

ইসির মনিটরিং কমিটির একজন সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নবীগঞ্জ, শিবগঞ্জ, মহেশপুর (দুটি), কচুয়া, মীরকাদিম, লাকসাম, দাগনভূঞা, মতলব উত্তর, সিরাজগঞ্জ পৌরসভার বিধি লঙ্ঘন ও প্রার্থীদের অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

“এদের কেউ কেউ গণমাধ্যমের সংবাদকে অতিরঞ্জিত বলেছেন,” বলেন এই কর্মকর্তা।

লাকসামে অভিযোগের কিছুটা সত্যতা পেলেও কাউকেই শনাক্ত করা যায়নি বলে প্রতিবেদনে লিখেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

কুমারখালী, শিবচর, গাইবান্ধা, বদরগঞ্জ, গোয়ালন্দে অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।

“এক্ষেত্রে প্রার্থীদের শো-কজ করা হয়েছে, এর বাইরে কিছুই করা যায়নি,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

তবে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বিধি লঙ্ঘনের জন্য সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপনকে শো-কজ করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। জবাবে ক্ষমতাসীন দলের এই সংসদ সদস্য ‘দায়িত্বশীল’ হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এছাড়া নান্দাইলের সংসদ সদস্য আনোয়ার আবেদীনকে সতর্ক করা হয়েছে, ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সংসদ সদস্যের বিষয়ে মতামত চেয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

নির্বাচন কমিশন

ইসি কর্মকর্তারা জানান, যেখানে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন, সেখান থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বেশি। তবে সত্যতা পাওয়া না যাওয়ায় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।

রকিব মণ্ডল জানান, মঙ্গলবার অন্তত ১৮ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং তিনজন পুলিশ সুপারকে ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিধিলঙ্ঘনের প্রতিবেদন’ পাঠিয়ে তার সত্যতা যাচাই করে ‘বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়ে ইসিকে জানাতে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এসব চিঠিতে বরগুনা, সাতক্ষীরা (দুটি), সোনারগাঁও, কুমারখালী, মাধবদী (দুটি), বাকেরগঞ্জ, তাহেরপুর (দুটি), বাজিতপুর (দুটি), বড়াইগ্রাম, আলমডাঙ্গা, গাংনী, কালিয়া (দুটি), মধুপুর, চৌগাছা, সিরাজগঞ্জ পৌরসভার সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ঝালকাঠি, বরিশাল ও জামালপুরের পুলিশ সুপারকে বিধি ভঙ্গের অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিয়ে ইসিকে জানাতে বলা হয়েছে।

বিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় আগে তিন সংসদ সদস্যকে সতর্ক করার পর এবার আরও ২০ জনকে চিঠি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা।

তবে নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেছেন, এখন আর চিঠি নয়, সরাসরি রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন তারা।