একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বহির্বিশ্বে নানা অপপ্রচার ঠেকাতে সরকারের তৎপরতায় ঘাটতি দেখলেও যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিকভাবে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের তুলনায় বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়াকে ভালো মনে করছেন একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ।
Published : 16 Dec 2015, 10:22 PM
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ভবিষ্যতে বাংলাদেশই দৃষ্টান্ত হবে বলেও মন্তব্য এসেছে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককুয়েরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে যেসব সংস্থা ও দেশ প্রশ্ন তুলেছে তাদের ‘দ্বিচারিতা’ তুলে ধরে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে তার মনে হয়েছে, এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালে বিশ্বজুড়ে জামায়াতে ইসলামীর ‘অর্থ ঢালার’ বিপরীতে এই বিচারের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়তে সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই বলে মনে করেন কয়েক দশক ধরে বিদেশে থাকা এই বাংলাদেশি।
ম্যাককুয়েরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ল’ হায়ার ডিগ্রি প্রোগ্রামের (এমফিল ও পিএইচডি) পরিচালক রফিকুলের মতে, দেশীয়ভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করে সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ।
এর ব্যাখ্যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের শুধু আফ্রিকানদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং তহবিল ফুরিয়ে গেলে সেখান থেকে সটকে পড়ার প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধাপরাধের বিচার ও এর নানা দিক এবং বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শুরু থেকে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ার ওপর নজর রেখে আসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক সুলাইমান নিলয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ট্রাইব্যুনালের বিচারের নানা প্রক্রিয়াগত বিষয় নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এটা সাধারণ ফৌজাদারি বিচারে আমাদের অভ্যস্থতার কারণে কি? এটা সরকার সঠিকভাবে স্পষ্ট করতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল ও ন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল কিন্তু আকাশ পাতাল পার্থক্য-এটা অনেকেই বোঝে না। যেটা ধরেন, সাক্ষীর ব্যাপারে। উদাহরণ দিচ্ছি, যেমন পত্রিকার খবর। দেশীয় ফৌজদারি আইনে এটা জাস্ট করোবরেটিভ এভিডেন্স। এটা সাবস্টানটিভ এভিডেন্স নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনে এটা সাবস্টানটিভ এভিডেন্স। কারণ অতীতের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে কেসগুলো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অপরাধ ঘটেছে, কত বছর আগে, চল্লিশের দশকের শুরুতে। আজকে ৯২ বছর বয়সী একজন নাৎসি গার্ডের বিচার হচ্ছে। এগুলো সাক্ষী সাবুদ কোথায় পাবে? আপনাকে আর্কাইভে যেতে হবে, হিস্ট্রিকাল সোর্সে যেতে হবে, সংবাদপত্রে যেতে হবে। সুতরাং সমস্ত প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
যে সব কথা আমরা ফলাও করে বলি, সেটা হয়তো ন্যাশনাল ল তে অ্যাপ্লিকেবল হতে পারে। আন্তর্জাতিক আইনে নয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোর বিচারের কথা বিভিন্ন সময়ে উঠেছে। একটা দলের বিষয়ে তদন্তও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আইন না থাকায় বিচার করা যাচ্ছে না। বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?
তবে বাংলাদেশ সংসদ যদি আইন তৈরি করে, স্থানীয় আইনে। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন ব্যক্তিকে শাস্তি দিচ্ছে।
বাংলাদেশ জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের একটা প্রভিশন আমাদের ১৯৭৩’র আইনে আছে। সেখানেও একটা দলকে কীভাবে ক্রিমিনালি রেসপনসিবল করবে, সেটা আমাদের সংসদ চিন্তা করতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন সদস্য ব্যক্তিগতভাবেও দায়ী হতে পারে, সমষ্টিগতভাবেও দায়ী হতে পারে। এই সব জিনিস বিবেচনা হতে পারে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: সার্বিক বিচারে ধীরগতি হচ্ছে বলে অনেকের অভিযোগ। আপনার মত কী?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: এটা একটা রিলেটিভ বিষয়। যদি আমাদের দিক থেকে দেখি, বিচার হয়ত বা ধীরগতিতে চলছে। বিচারকদের এটা মাথায় রাখা দরকার, একটা বিশেষ বিচার করছি। ৭৩’র আইন বিশেষভাবে বলে দিয়েছে, বিচারগুলো দ্রুত হবে। কোনো টেকনিকালিটিতে এটাকে থামানো যাবে না-এগুলো সব কিছু বলা আছে। আমাদের অভিযুক্ত, সাক্ষী সবাই বয়স্ক। গোলাম আযম, আলিম বিচার চলাকালে মারা গেছে। আরেকজন বিচার শুরুর আগেই মারা গেছে।
স্লোবোদান মিলোসেভিচ বিচারের আগে মারা গেল। আইনগত কী হয়েছে? যতক্ষণ পর্যন্ত আইন না বলবে- তুমি গিল্টি, ততক্ষণ তিনি নিরাপরাধ। কারণ বিচার এখনও শেষ হয়নি। যারা ভিক্টিম, তারা চিরদিনের জন্য বিচার বঞ্চিত হল।
আপনি যদি আন্তর্জাতিকভাবে তুলনা করেন আমাদেরটা অনেক ফাস্টার। কিন্তু আমি মনে করি, আরেকটু দ্রুত হলে ভালো হতো।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বিভিন্ন সময়ে আসামিপক্ষ যথাযথ সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ করেছে। অন্য দেশের ট্রায়ালগুলোতে আসামিরা কী পরিমাণ সুযোগ পেয়েছিল বা পাচ্ছে?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: আমাদের বিচারে বিচারকরা উদার, যেটা অন্যরা নয়। ডিফেন্স সব সময় এই প্রক্রিয়াকে স্লো করতে চেয়েছে। তারা কারণে অকারণে আদালতে অনুপস্থিত থেকেছে। সাক্ষীর যে সব সংখ্যা তারা আদালতে দিয়েছে, এইগুলো সাক্ষী যদি ডিল করেন, কত যুগ যে লাগবে, কেউ জানে না।
অন্যরা কী করে, শোনেন, যুগোস্লাভ ট্রাইব্যুনালের রুল ৭৩ এ দুইপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে ট্রাইব্যুনালকে ক্ষমতা দেওয়া আছে। সেখানকার টাডিক কেসে যখন সময় বেশি লাগলো, তখন তারা প্রি-ট্রায়ালে সময় বেঁধে দিল, পরেও যখন দেখা গেল, এটা কাজ করছে না। সেই ধারাকে তারা চারবার চেইঞ্জ করেছে। প্রত্যেকটা মামলায় কোর্ট বলে দেয়, এতটার বেশি সাক্ষী আমরা গ্রহণ করব না।
স্লোবোদান মারা যাওয়ার পর কতগুলো চার্জ আনা যাবে, সেটাও তারা ডিটেক্ট করে দিচ্ছে। চূড়ান্তভাবে বলছে, এত মিনিটের মধ্যে যদি তুমি চার্জ প্রমাণ করতে না পারো বা ডিসপ্রুফ করতে না পারো, তাহলে ইউ হ্যাভ নো চান্স, নো স্টান্ডিং বিফোর দি কোর্ট।
দ্রুত বিচার করার জন্য সবাই এই প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যই সেটা। এটা সাধারণ অপরাধের বিচার নয়। এগুলো কখনোই প্রক্রিয়াগত জটিলতায় বিলম্ব না হয়, সেটা আইনে পরিষ্কার বলা আছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভিক্টিমদেরকে ন্যায়বিচার প্রদান করা। সেটা করতে গিয়ে আসামিপক্ষকে কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। এগুলো অবলম্বনমাত্র। সেই সুযোগ আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে গিয়ে যদি আসল বিচারই না হয়, তাহলে তো এই বিচারের দরকার ছিল না। অবলম্বন যখন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, সেগুলোকে কেটে ফেলতে হবে। যুগোস্লাভ ট্রাইব্যুনাল সেটাই করেছে।
অন্যদের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে বাংলাদেশে ডিফেন্স (আসামিপক্ষ) অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছে। সব থেকে বড় অধিকার হচ্ছে, আপিল পদ্ধতি। কোথাও ইন হাউজ ছাড়া নাই। বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
দুনিয়ার কোথাও শর্তহীন আপিল নাই। আপিল সব সময়ই শর্তযুক্ত। কোন ভুল হয়েছে, কেন নতুন সাক্ষী বেরিয়েছে, বাংলাদেশে কোনো শর্ত নাই। ঢালাওভাবে দুনিয়ার কোথাও নাই। এখানে জেনারোসিটি দেখানো হয়েছে। কোথাও রিভিউ’র সুযোগ নাই। আমরা দিচ্ছি।
বাংলাদেশের ডিফেন্সকে বেশি সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আপিলটাকে শর্ত সাপেক্ষে করা দরকার ছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিদেশ থেকে সাক্ষী আনতে চেয়েছিলেন? আইনজীবীও আনতে চেয়েছেন অনেকে। বিদেশি আইনজীবী সাক্ষী আনার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল কি?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: রিভিউতে বা আপিলে তো নতুন করে সাক্ষী নেওয়ার কিছু নাই। রিভিউতে তো নতুন করে সাক্ষী আনার কিছু নাই। তাদের সেটা করার দরকার ছিল বিচারের সময়। সাক্ষী বিচারের সময় নেওয়া হয়। দুনিয়ার কোথাও এই বিধান নেই যে, রিভিউ’র সময় সাক্ষী গ্রহণ শুরু হয়, মামলা নতুন করে শুরু হয়।
আইনজীবীর ক্ষেত্রে এখানে কোর্টে প্রাকটিস করতে হয়, আপনার নিবন্ধন দরকার হয়। এখানে বার কাউন্সিলও যুক্ত হতে পারে। যদি অস্ট্রেলিয়াতে কোর্টে দাঁড়াবেন, আপনি মহারাজ হলেও ইউ আর নট অ্যালাউড। আপনাকে অস্টেলিয়াতে নিবন্ধিত হতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় যখন যাবেন, সরকার তখনই পিকচারে আসবে। সেটাতো তাদের বিষয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: তদন্ত সংস্থার দুর্বলতার জন্য সাঈদীর ফাঁসি হয়নি বলে অ্যাটর্নি জেনারেল একদিন মন্তব্য করেছিলেন। এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: তদন্তে দুর্বলতা থাকতে পারে। দুনিয়ার কোনো ট্রায়াল পারফেক্ট নয়। বাংলাদেশেরটাও পারফেক্ট বলছি না। মানুষ হিসাবে সেটা সম্ভবও নয়। অন্যান্য ট্রায়ালের ল্যাকিংগুলো যদি বলি, সেটা লোমহর্ষক। তার তুলনায় বাংলাদেশেরটা জাস্ট পিনাট (যৎসামান্য)।
পূর্ব তিমুর ৪০০ লোকের বিরুদ্ধে চার্জ এনেছিল। কাস্টডিতে নিল। তারা ৮৮ জন লোকের বিচার করতে পেরেছে। ২০০৪ সাল নিরাপত্তা পরিষদ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল তারা আর ফান্ড দিবে না। যেই ফান্ড দিবে না, তখনই সাদা বিচারক চলে গেল। তারপর যারা কাস্টডিতে ছিল, তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল। আপিল প্রত্যাহার হয়ে গেল। এটা ইউএন মিক্সড ট্রায়াল।
আমি বলব, বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল প্রেসারের মধ্যে যে পারফর্ম করেছে, সেটা অন্য সবার চেয়ে ভালো। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে জাতীয় পর্যায়ে বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধের।
বাংলাদেশ কোনো স্ট্যান্ডার্ড ফলো করার জন্য না। বাংলাদেশ নতুন স্ট্যান্ডার্ড সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী আমি মনে করি। ভবিষ্যতে যে সব ট্রাইব্যুনাল হবে তাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে বাধ্য আমি বলব। কারণ আইসিসি ফেইল করছে। আইসিসি কেনিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে চেষ্টা করেছিল। আজ চার বছর কেইস চালানোর পর এটা ড্রপড। তারা কোনো এভিডেন্সই সংগ্রহ করতে পারেনি।
আইসিসি সাইফ আল গাদ্দাফির (লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে) বিচার করতে চাইল। লিবিয়া বলল, আমরা বিচার করব। লিবিয়া বিচার করছে। আইসিসি নিরাপত্তা পরিষদকে বলেছে। নিরাপত্তা পরিষদ কী করবে? সবাই জানে, এটা কুখ্যাত প্রতিষ্ঠান। তারা বিশ্ব শান্তির জন্য কিছুই করবে না।
যার ফলে শুরু থেকে আইসিসি দুটো কেইস নিয়েছিল, কেনিয়া ও লিবিয়া। দুটোতেই আসিসি ফেইলড। এই সব ক্রাইমের বিচার যদি করতেই হয় তাহলে ন্যাশনাল ট্রায়াল ছাড়া কোনো উপায় নেই। কেউই করতে পারবে না। এটার সুবিধা হচ্ছে, আপনি করছেন, যেখানে ভিক্টিমেরা আছে, সাক্ষীরা আছে, জনগণ আছে। জনগণের সংযুক্তিতে একটা মালিকানা এবং ক্ষমতায়নের একটা আর্থ সামাজিক প্রভাব সেটা আমরা পাচ্ছি।
বাইরের আর্থিক কোনো প্রভাব নেই। অনেক দিক থেকে বাংলাদেশের ট্রায়াল ইজ ডুয়িং পারফেক্টলি অলরাইট ইন মেনি মেনি ইন্সট্যান্সেস। যারা বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করে, তাদের আমি নিষেধ করছি না, এখানে যেন আর্টিফিসিয়াল ইন ইগজাজারেটেড ইম্পারফেকশনগুলো হাই লাইট না করে এই বিচারের অর্জনগুলো, এই দুঃসাহসিক কাজ করছে, এটাকে অভিনন্দন জানানো উচিত। সারা বিশ্ব ব্যর্থ হয়েছে, এই বিচার করতে জাতিসংঘও ব্যর্থ হয়েছে। এর যদি কোন ভুল হয়েও থাকে, এটাকে সাপোর্টের মাধ্যমে রেকটিফাই করে আরো উন্নতি করা উচিত। যাতে শুধু বাংলাদেশই নয়, এই দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশেরও হেল্প হবে।
সমালোচনা করার চেয়ে বিশ্ববাসীকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দেওয়া উচিত।
যেটা আমি বলতে চেয়েছি, অনেক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আমাদের সমালোচনা করেন, তারা যেগুলোতে যুক্ত হয়েছেন, সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করা উচিত। বাংলাদেশকে তো এককভাবে সমালোচনা করা যাবে না। সুতরাং আমি মনে করি, তারা যে তাদের স্ট্যান্ডার্ড আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়, যেমন ধরেন, আমেরিকানরা আমাদের সমালোচনা করে। কোন স্ট্যান্ডার্ডের কথা তারা বলে? গুয়ানতানামো বে স্ট্যান্ডার্ড? যেখানে ২০০১ সাল থেকে লোক বন্দি আছে কোনো অভিযোগ কোনো বিচার ছাড়া। তারা কি সেই মান আমাদেরকে ফলো করতে বলেছে?
তারা কি আবু গারিবে যা করেছিল, সেই স্ট্যান্ডার্ড ফলো করতে বলছে? সিআইএ’র সেই স্ট্যান্ডার্ড যেখানে লোককে হাইজ্যাক করে নিয়ে টর্চার আউট সোর্সিং করছে।
তারা কি ওয়াটার বোর্ডিং পানিশমেন্ট ফলো করতে বলছে, যেটা অমানবিক ও নিষিদ্ধ। তারা সেটা প্রাকটিস করছে।
আমাকে বলতে হলে আপনাকে ক্লিন হ্যান্ডে আসতে হবে। নিজেরা নিজেদের সাইটকে ব্লক করে অন্যের সমালোচনা করার চেষ্টা করে। নিশ্চয়ই আমি মনে করি, কোন না কোন ভেস্টেড ইন্টারেস্টে তারা এটা করে।
অনেকেই জামায়াতের টাকা খায়, সেটাও হতে পারে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক ফয়েজ আব্বাস যে সব কথা বলে, তার সঙ্গে আমিতো জামাতি পলিসির কোনো পার্থক্য পাই না। আপনি যদি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দেখেন, সাদ্দাম হোসেনের ইরাক আক্রমণের সময় তাদের রোল দেখেন। তখন তারা কোথায় ছিল? এই যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট আজকে ৩৪ কেস করছে, সবগুলো আফ্রিকা থেকে এসেছে। নেটো, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড-এরা লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানে কী করেছে, তাদের কিন্তু বিচার হয় না। রাশিয়া চেচনিয়াতে কী করেছে, তাদের কিন্তু কোনো বিচার হয় না। চীন তিব্বতে কী করছে, তাদের বিচার হয় না। বিচার হয় শুধু আফ্রিকানদের।
দুর্বলের প্রতি বিচারের বাণী শোনানো, সবলকে স্পর্শ না করা। প্রেসিডেন্সি শেষ হলে বুশকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তোমার রিগ্রেট কী? সে বলেছিল, ইরাক যুদ্ধ। টনি ব্লেয়ার সেইদিন ক্ষমা চেয়েছে। কই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কিছু বলেছে? যখন ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া গেল না, তখন কিছু বলেছে? এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।
তারা বাংলাদেশকে এখনও দুর্বল মনে করে। তারা মনে করে ৭৩-৭৪-৭৫ এর মতো অসহায় অবস্থায় আছে, যখন তাদের ন্যাশন বিল্ডিং দরকার হয়েছে। বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, অনেক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে পারে, এটা তারা স্বীকৃতি দিতে চায় না।
এগুলো আমাদের আসবেই, এর ভিতর দিয়েই কাজ করতে হবে।
সুদানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দারফুর নিয়ে যখন অভিযোগ গেল, তখন আইসিসির প্রসিকিউটর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের করে দিল। একই জিনিস লিবিয়ার গাদ্দাফির ক্ষেত্রে হয়েছিল। কই বুশের ক্ষেত্রে তো হয় না, ব্লেয়ারের ক্ষেত্রে তো হয় না।
আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ কি খালি আফ্রিকায়ই হচ্ছে?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: শাহবাগের উত্থান এই বিচারকে প্রভাবিত করেছে?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: আমি মনে করি না তা। শাহবাগ একটা অনুভূতি। এর সঙ্গে বিচারের কোনো সম্পর্ক নাই। আপনারা রায়গুলো পড়েন, তাহলে দেখবেন, আমি মনে করি না তাতে শাহবাগের প্রভাব আছে।
১৯৭১ সালে যা ঘটেছে ও পরবর্তীতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যখন ক্ষমতায় ছিল, শাহবাগ হচ্ছে তারই একটা প্রতিক্রিয়া। রিঅ্যাকশনের সঙ্গে আইন-আদালতের কোনো সম্পর্ক আমি দেখিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বিচারে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল বলে আপনার মনে হয়েছে?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: রায়ে আমি তা দেখিনি। প্রত্যেকটা রায় কনসিসট্যান্ট। প্রফেশনালিজম অনেক ইমপ্রুভ করেছে। আমি রায়ে এমন কিছু পাইনি যাতে, আমরা…..
আমার জানা মতে না, আমি রায়গুলো পড়েছি, আমার কাছে মনে হয়নি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: সরকার এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করছে বলেও একটা অভিযোগ বিরোধী রাজনৈতিক জোটের রয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বিচারকে কেন্দ্র করে যে সব প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে সেগুলো সরকার ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: আমি বলব- সরকার এই ব্যাপারে উদাসীন ছিল। জামায়াত বিদেশে যেভাবে সক্রিয়, হাই কমিশন-দূতাবাসগুলো, আমার জানা মতে, দৃষ্টিগোচর হওয়ার মতো কিছুই করেনি। অস্ট্রেলিয়াতে তো কিছুই করা হয়নি। একবার অস্ট্রেলিয়াতে তারা (জামায়াত) সংসদ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ইনডিভিজুয়াল অর্গানাইজেশন, পিপল এটাকে প্রতিহত করেছে। সরকারের থেকে কোনো পদক্ষেপ ছিল না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বিচার শেষ হওয়ার পর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের যে বিতর্ক আছে, সেটা শেষ হয়ে যাবে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: এটাতো বলা কঠিন, যতদিন পর্যন্ত স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বাংলাদেশকে পূর্ণরূপে মেনে নিয়েছে, ততদিন এই বিভক্তি, বিবাদ, বিতর্ক চলতেই থাকবে। সাকা-মুজাহিদের সময় দেখেছেন, পাকিস্তান থেকে কী ধরনের কথা বলা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও পাকিস্তানের হয়ে কাজ করেছে। এই ধরনের লোক যদি থাকে, সক্রিয় ভূমিকায় থাকে, তাহলে এই বিভক্তি থাকবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: এটা কিভাবে শেষ হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: এটা আমার পক্ষে বলা কঠিন, এর কোনো আইনগত সমাধান নেই। সরকারকে এটা রাজনৈতিকভাবে প্রেস করতে হবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: আমি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে সার্বিকভাবে হ্যাপি। কারণ আমি বিশ্বের সবগুলো ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আমি পড়েছি। আমি যেটা বলতে চাই, সারা দুনিয়ায় এমন কোনো ট্রাইব্যুনাল আজও হয়নি, যেটা পারফেক্ট। মানুষ হিসাবে এটা সম্ভবও নয়। হিউম্যানলি এটা আনঅ্যাচিভেবল। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইম্পারফেকশন থাকতে পারে, সেটাকে হাইলাইট করে অতিরঞ্জিত করার কোনো কারণ নেই। সেটাকে যদি কেউ চিন্তাও করে, তাদের উচিত হবে, বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালের অর্জনগুলো ধরে রাখা।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল আজকে যা করছে, এটা ভবিষ্যতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই বিচার প্রক্রিয়া যে বিচারকরা করছেন, ইতিহাসে তাদের স্থান থাকবে। এই বিচারের দৃষ্টান্ত, পদ্ধতি, জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন, যেগুলো তারা দিয়েছে, এগুলো ভবিষ্যতের আদালতের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমি মনে করি, এটা একটা ভ্যালুয়েবল এক্সারসাইজ।
বিশেষ করে আজকে সন্ত্রাসবাদের যুগে, এই রকম একটা সিভিল ও জুডিশিয়াল রেসপন্স। ৭১-এ তো তারা মানবতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করেছে। টিট ফর ট্যাট না করে, সিভিল ও জুডিশিয়াল রেসপন্স দিচ্ছে, এটা আমাদের দেশের আইনের অনুশাসনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। বিশ্বের ইতিহাসকে এটাকে এক সময় স্বীকৃতি দিতে হবে।
[অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৫১ সালে বগুড়ায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার পর এলএলবি ডিগ্রি নেন। পরে ১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক আইনে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম এবং পরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিয়ে বর্তমানে গবেষণারত রফিকুলের পিএইচডি থিসিসের উপর ‘দ্য বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার মুভমেন্ট : ইন্টারন্যাশনাল লিগ্যাল ইমপ্লিকেশনস’ নামে একটি বই রয়েছে]